,

‘ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে’ চাল বরাদ্দে নানা অনিয়ম

জেলা প্রতিনিধি, মৌলভীবাজার: প্রায় তিন মাস আগে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নামে চাল বরাদ্দ হয়েছে। অথচ প্রতিষ্ঠানের সভাপতিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। ওই চাল বিক্রি করে ক্ষমতাসীন দলের নেতাসহ অন্য ব্যক্তিরা টাকা নিয়ে গেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ঘটনাটি ঘটেছে মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায়।

উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, গত ২০২২-২৩ অর্থ বছরের জুন মাসে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় জুড়ী উপজেলার ৫০টি সরকারি-বেসরকারি এতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিং ও সামাজিক কল্যাণে নিয়োজিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ২ মেট্রিক টন করে ১০০ মেট্রিক টন জিআরের চাল বরাদ্দের চিঠি দেয়। চিঠিতে এসব প্রতিষ্ঠানে আহার্য খাতে ওই চাল ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা হয়।

পরে ২৫ জুন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখা ৫০টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি করে স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের সভাপতি-সম্পাদকের নামে ছাড়পত্র (ডিও) প্রদান করে। তালিকায় মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসা ও এতিমখানার নাম রয়েছে। এরপর ছাড়পত্রের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের নামে উপজেলা খাদ্যগুদাম থেকে চাল তোলা হয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, তালিকায় ৩ নম্বর ক্রমিকে উপজেলার জায়ফরনগর ইউনিয়নের নয়াগ্রাম-শিমুলতলা দাখিল মাদ্রাসার নাম রয়েছে।

প্রতিষ্ঠানের সভাপতি জায়ফরনগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মনিরুল ইসলাম বলেন, চাল বরাদ্দের বিষয়ে তাঁকে কেউ কিছু জানাননি। তাঁদের প্রতিষ্ঠান কোনো চাল পায়নি।

ছাড়পত্রে ওই প্রতিষ্ঠানের নাম নয়াগ্রাম-শিমুলতলা হাফিজিয়া দাখিল মাদ্রাসা, সভাপতি আবদুস সাত্তার উল্লেখ করা। এতে আবদুস সাত্তারের সইও রয়েছে। সাত্তার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তাঁর বাড়িও নয়াগ্রাম এলাকায়।

আবদুস সাত্তার দাবি করেন, তালিকায় নয়াগ্রাম-শিমুলতলা হাফিজিয়া মাদ্রাসা লেখার কথা ছিল। ভুলে এর সঙ্গে দাখিল উল্লেখ করা হয়েছে। হাফিজিয়া মাদ্রাসাটি তাঁরা নিজেদের জমিতে স্থাপন করেছেন। ২ মেট্রিক টন চাল বিক্রি করে তিনি ৬০ হাজার টাকা পেয়েছেন।

তালিকায় ২ নম্বর ক্রমিকে থাকা জায়ফরনগর ইউনিয়নের কণ্ঠিনালা আতিকিয়া নুরানি হাফিজিয়া মাদ্রাসার সভাপতি ফিরোজ মিয়া জানান, তাঁরা চাল পাননি। ছাড়পত্রে প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে উপজেলা পরিষদ চত্বর মসজিদের ইমাম আরিফ বিল্লাহর নাম রয়েছে।

আরিফ বিল্লাহ বলেন, তিনি প্রায়ই ওই প্রতিষ্ঠানে সরকারি বরাদ্দ পেতে সহযোগিতা করেন। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় (পিআইও) থেকে ওই প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ ২ মেট্রিক টন চালের মূল্য বাবদ তাঁকে ৬০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। সম্প্রতি তিনি টাকা হস্তান্তর করতে সভাপতি ফিরোজ মিয়ার কাছে যান। কিন্তু ফিরোজ দুই মেট্রিক টন চালের বাজারমূল্য আরও বেশি জানিয়ে টাকা গ্রহণে আপত্তি জানান।

তালিকায় ২৩ নম্বর ক্রমিকে থাকা জায়ফরনগর ইউনিয়নের জামেয়া ইসলামিয়ার সহসভাপতি দাবি করে উপজেলার জায়ফরনগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদির বলেছেন, প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ ২ মেট্রিক টন চালের মূল্য বাবদ ৬০ হাজার টাকা পেয়েছেন। গত শুক্রবার সকালে উপজেলার পিআইও কার্যালয় থেকে ওই টাকা পাঠানো হয়।

আবদুল কাদির বলেন, তালিকায় তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নাম, জুড়ী জামেয়া ইসলামিয়া মহিলা মাদ্রাসা হওয়ার কথা ছিল। উপজেলা সদরের কামিনীগঞ্জ বাজার এলাকায় প্রতিষ্ঠানটির জন্য জমি কেনা হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যেই সেখানে মাটিভরাটের কাজ শুরু হবে।

আবদুল কাদিরের দাবি, গত জুন মাসে বরাদ্দের পর বদরুল ইসলাম নামের তাঁদের প্রতিষ্ঠানের এক শিক্ষক সভাপতি হিসেবে চালের ছাড়পত্রে সই করেন।

আবদুল কাদির বলেন, তিনি তালিকায় ৩৭ ও ৩৮ নম্বর ক্রমিকে থাকা জায়ফরনগর ইউনিয়নের কামিনীগঞ্জ বাজার জামেয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা এবং কামিনীগঞ্জ বাজার বড় মসজিদের পক্ষে চালের ছাড়পত্রে সই করেন। দুটি প্রতিষ্ঠানের চালের মূল্য বাবদ ৬০ হাজার টাকা করে মোট ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পেয়েছেন।

তালিকায় ৪ নম্বর ক্রমিকে গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের শিলুয়া-যোগীমোড়া জামে মসজিদের নাম রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের সভাপতি নজরুল ইসলাম চালের বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। ছাড়পত্রে জয়নাল আবেদীন নামের এক ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে চাল তুলে নিয়ে গেছেন। ওই ব্যক্তিরও কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি।

তালিকায় ২৯ নম্বর ক্রমিকে এলবিনটিলা সর্বজনীন জগন্নাথ মন্দিরের সভাপতি উল্লেখ করে নন্দ বুনারজি নামের এক ব্যক্তি চাল তুলেছেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের সভাপতি বীরেন্দ্র বুনারজি বলেছেন, তাঁরা চাল পাননি। নন্দ বুনারজি নামের তাঁদের এলাকায় কেউ নেই।

বরাদ্দের তালিকা তৈরির সময় উপজেলায় পিআইওর দায়িত্বে ছিলেন নওগাঁর ধামইরহাটের বর্তমান পিআইও মনসুর আলী।

মনসুর আলী গত বৃহস্পতিবার মুঠোফোনে বলেন, সময় কম থাকায় স্থানীয় বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েকজন জনপ্রতিনিধির সহযোগিতায় তড়িঘড়ি করে তালিকা তৈরি করা হয়। এ সময় প্রতিষ্ঠানসহ সভাপতি-সম্পাদকের নাম টাইপে কিছুটা ত্রুটি হতে পারে। তবে সব প্রতিষ্ঠান চাল পেয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। এ ছাড়া কার্যালয় থেকে নগদ টাকা প্রদানের বিষয়টিও সঠিক নয় বলে দাবি করেন। চাল তোলার পর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা ব্যবসায়ীদের কাছে তা বিক্রি করে দিতে পারেন বলে তিনি মন্তব্য করেন।

বর্তমান পিআইও মিজানুর রহমান বলেন, এ ধরনের ঘটনাগুলো খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

ইউএনও রঞ্জন চন্দ্র দে বলেন, এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এই বিভাগের আরও খবর