,

গরিবের কোটি কোটি টাকা মেরে উধাও এনজিও

কুমিল্লা প্রতিনিধি: সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার কথা বলে কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলায় শত শত গরিবের কোটি টাকা হাতিয়ে প্রতারণা করে রাতের আধারে পালিয়ে গেছে ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি’ (বিডিএস) নামে একটি এনজিও। মাত্র ১০ হাজার টাকা সঞ্চয় জমা রেখে দুই বছরের কিস্তিতে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার কথা বলে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি।

সোমবার (২১ অক্টোবর) রাতে চাঞ্চল্যকর এ প্রতারণার ঘটনাটি ঘটেছে বুড়িচং উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নের ইছাপুরা গ্রামে।

পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, গ্রাহকদের মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) সকালে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও, থানার ওসি, স্থানীয় চেয়ারম্যান এবং জনপ্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে ঋণ দেওয়ার কথা ছিল প্রতারক চক্রটির।

এ দিকে, কথা মতো ঋণ নিতে আগ্রহী সঞ্চয় জমা দেওয়া গ্রাহকেরা সকালে অফিসের সামনে এসে দেখেন বিল্ডিং এ প্রতিষ্ঠানটির সাইনবোর্ড নেই। পাশাপাশি পাঁচ বছরের চুক্তিতে ভাড়া নেওয়া শফিক মিয়ার মালিকানাধীন ভবনের নিচতলার অফিসটিও তালাবদ্ধ। ধীরে ধীরে নারী-পুরুষসহ সকল গ্রাহকেরা ঘটনাস্থলে সমবেত হলে সকলেই বুঝতে পারেন তারা প্রতারিত হয়েছে। ঋণ দেওয়ার কথা বলে প্রতি লাখের জন্য ১০ হাজার টাকা করে সঞ্চয় আমানতের টাকা নিয়ে পালিয়েছে ‘বাংলাদেশ ডেভলপমেন্ট সোসাইটি’ (বিডিএস) নামে ওই এনজিওটির ম্যানেজার হিসেবে পরিচয় দেওয়া ধূর্ত আবুল কালাম আজাদ। পরবর্তীতে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহকদের উপস্থিতির পাশাপাশি বাড়তে থাকে খেটে খাওয়া মানুষের আহাজারি।

উপস্থিত এলাকাবাসী, বাড়ির মালিক ও স্থানীয় ইউপি মেম্বার আকতার হোসেনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ১০ দিন আগে প্রবাসী শফিক মিয়ার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে ভাড়াটিয়া হিসেবে কোনো প্রকার ডকুমেন্টস ছাড়াই একটি ফ্লাট ভাড়া নেয় ধূর্ত আবুল কালাম আজাদ। নিজেকে এরিয়া ম্যানেজার পরিচয় দিয়ে বুড়িচংয়ের বিজয়পাড়া এলাকার নাজির মিয়ার মেয়ে উম্মে খাদিজাসহ আরও স্থানীয় দুইজনকে বেশি বেতন দেওয়ার কথা বলে অপর একটি এনজিও থেকে এনে নিয়োগ দেন বিডিএস নামে এই ভুয়া প্রতিষ্ঠানটিতে।

এরপর স্থানীয়দের মাঠকর্মী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে আবুল কালাম আজাদ নামের ওই ব্যক্তি তাদের মাধ্যমে গাজিপুর এলাকার ইনুছ মিয়ার স্ত্রী রওশন আরাকে ৫০ লাখ টাকা গৃহঋণ দেওয়ার কথা বলে আমানত সঞ্চয় হিসেবে এক লাখ ২০ হাজার টাকা নগদে নিয়ে নেন। অপরদিকে গ্রামের মৃত জলফু মিয়ার ছেলে খোরশেদের কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকা নেন ছয় লাখ টাকা ঋণ দেওয়ার কথা বলে। একইভাবে শাকতলা এলাকার ব্যবসায়ী রিপন ও সদর দক্ষিণ উপজেলার খোরশেদ মিয়ার কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা করে গৃহঋণ দেওয়ার কথা বলে হাতিয়ে নেন তিন লাখ টাকা করে মোট ছয় লাখ টাকা।

এমনকি শিকার গ্রামের সাবেক মেম্বার মনির হোসেন থেকে কৃষিঋণ দেওয়ার কথা বলে ২০ হাজার টাকা, আব্দুল কু্দ্দুস থেকে ২০ হাজার, ইউসুফ মিয়ার স্ত্রী রোকসানার কাছ থেকে ৪০ হাজার, গাজীপুর গ্রামের দুলাল মিয়ার স্ত্রী থেকে ১০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। এমনভাবে আশপাশের ছয়টি গ্রামের শতাধিক নারী-পুরুষ থেকে কোটি টাকার ঊর্ধ্বে হাতিয়ে নিয়ে রাতারাতি গায়েব হয়ে যায় প্রতারক চক্রটি।

ভুক্তভোগীরা সকলেই নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্য জানিয়ে তারা বলেন, ‘আমাদের বলা হয়েছে সরকার অনুমোদিত ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচির আওতায় গ্রামীণ জনপদকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করতে ব্যবসা, কৃষি, পশুপাখি, গৃহ নির্মাণ, মৎস্য চাষ, প্রবাসী, অটো, সিএনজি ক্রয় লোনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা ঋণ প্রদান করে থাকে। ‘বাংলাদেশ ডেভলপমেন্ট সোসাইটির’ (বিডিএস) প্রধান কার্যালয় বরিশালে। আমরা উপজেলার পরিচিত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে এর সত্যতাও পাই। এরপর টাকা জমা দেই ঋণ পাওয়ার আশায়।’

তারা আরও বলেন, ‘ঋণের আশায় ধার-দেনা করে টাকা জমা দিয়েছি। সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে ঋণ দেবে এ আশা নিয়ে এখানে এসে দেখি আবুল কালাম আজাদসহ অফিসের সকলে লাপাত্তা, আর অফিসকক্ষেও তালা ঝুলছে। পরে তার ফোন নম্বরটিতে ফোন দিলে  নম্বরটিও বন্ধ পাই। এখন আমরা কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না।’

এ সময় প্রতারণার শিকার বেশ কয়েকজন নারীকে অফিসের গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখা যায়।

এ দিকে, ভাড়াটিয়া সম্পর্কে বাড়ির মালিক সৌদি প্রবাসী শফিকুর রহমানের স্ত্রী জেসমিন আক্তারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভাড়াটিয়ার কোনো ছবি, চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট কিংবা কোনো এনআইডি কার্ডের ফটোকপি কিছুই তার কাছে নেই। মিটিংয়ে কথা বলে গভীর রাতে সাইনবোর্ড খোলার সময় তিনি দেখেছেন বলেও স্বীকার করেন।

এ বিষয়ে ষোলনল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘তারা পালিয়ে গেছে কি না জানি না, তবে, গতকাল আমাকে একজন ঋণ প্রদানের একটি অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকতে দাওয়াত করেন। এখন আপনার কাছে বিষয়টি শুনলাম যা অত্যন্ত দুঃখজনক। যাদের থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ওই চক্রটি তারা সকলেই আমার নিজ গ্রাম ও আশপাশের গ্রামের বাসিন্দা।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বুড়িচং থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আকুল চন্দ্র বিশ্বাস জানান, বিষয়টি তিনিও শুনেছেন। এ সময় ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের থানায় অভিযোগ দায়ের করতে বলা হয়েছে। এ সময় অভিযোগ দায়েরের পর এ বিষয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর