,

এখনও বিচারের আশায় দিন গুনছেন মা

জেলা প্রতিনিধি, কুড়িগ্রাম: আমার মেয়েকে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে মারছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। মেয়ের জন্য ১২টা বছর ধরে কাঁদছি। এক মুহূর্তের জন্য সেই দিনের কথা ভুলতে পারি না। এভাবেই কান্না জড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন, মৃত ফেলানীর মা জাহানারা বেগম।

তিনি বলেন, আমি চাই দুই দেশের সরকার মিলে আমার মেয়ে হত্যার বিচারটা করুক। বিচারটা হলে আমার আত্মা শান্তি পাবে। আমার সরকারের কাছে দাবি কোন মা যেন আর সন্তান সন্তান করে না কাঁদে।

ফেলানীর বাবা মো. নুর ইসলাম বলেন, ফেলানীকে বিয়ে দিতে সঙ্গে করে সীমান্ত পাড়ি দেয়ার সময় আমার চোখের সামনে বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোঁষ আমার মেয়েকে হত্যা করেছে। আমি অমিয় ঘোঁষের ফাঁসি চাই। দু’দেশের সরকার যেন সঠিক বিচারটা করে।

তিনি আরও বলেন, মেয়ে হত্যার ১২ বছর পেরিয়ে গেল এখনো বিচার পেলাম না। দুইবার বিচারের জন্য ঢাকা নিয়ে গেছে কোন লাভ হয়নি। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে কেঁদে কেঁদে বিচার চাইছি। আমার নাবালক মেয়েটারে বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোঁষ অনেক কষ্ট দিয়া মারছে। এখনো বিচার পাইলাম না, বিচার কী দুনিয়ায় নাই।

দেশ-বিদেশে আলোচিত এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও বিচার পায়নি তার পরিবার। বিচারিক কাজ ভারতের উচ্চ আদালতে ঝুলে থাকায় এখনও ন্যায় বিচারের আশায় অপেক্ষার প্রহর গুনছেন ফেলানীর বাবা-মা। এদিকে করোনা পরিস্থিতিতে বিচারিক কাজ বিলম্বিত হলেও শেষ পর্যন্ত ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সীমান্ত হত্যা বন্ধের প্রত্যাশা বিশিষ্টজনদের।

২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে বাবার সঙ্গে কাঁটাতারের বেড়া পার হওয়ার সময় বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষের গুলিতে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হয় বাংলাদেশি কিশোরী ফেলানী খাতুন। ফেলানীর মরদেহ কয়েক ঘণ্টা কাঁটাতারে ঝুলে থাকার দৃশ্য দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমসহ মানবাধিকার কর্মীদের মাঝে সমালোচনার ঝড় তোলে। পরে ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট ভারতের কোচবিহারের বিএসএফ’র বিশেষ আদালতে ফেলানী হত্যার বিচার কাজ শুরু হয়। একই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে বেকসুর খালাস দেয় বিএসএফ’র বিশেষ আদালত।

বিজিবির আপত্তিতে ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পুনঃবিচার শুরু হলেও সেখানে খালাস দেয়া হয় অভিযুক্ত অমিয় ঘোষকে। এরপর ২০১৫ সালের ১৪ জুলাই ভারতীয় মানবাধিকার সুরক্ষার (মাসুম) মাধ্যমে ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দাখিল করেন। পিটিশনের ভিত্তিতে কয়েক দফায় শুনানির দিন পেছালেও এখনও আদালতেই ঝুলে আছে পিটিশনটি। এ অবস্থায় অনেকটা হতাশার মধ্যে থাকলেও মেয়ের হত্যাকারীর সর্বোচ্চ শাস্তিসহ ন্যায় বিচারের আশা করছেন তার পরিবার।

মৃত ফেলানীর ছোট ভাই জাহান উদ্দিন বলেন, ১২ বছর হলে গেল আমার বড় বোন হত্যার বিচার পেলাম না। ফেলানী আপু আমাদের যে কত আদর যত্ন করত ভুলতে পারি না। যার বোন হারিয়েছে তারাই শুধু বলতে পারবে বোন হারানো কষ্ট কি। তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার আকুল আবেদন আমার বোনকে যে মারছে তার যেন সঠিক বিচারটা হয়।

নাগেশ্বরী উপজেলার রামখানা ইউনিয়নের কলনিটারী গ্রামের ফেলানীর পরিবারের প্রতিবেশী আমিনুল ইসলাম ও আব্দুল খালেক বলেন, ফেলানী হত্যার বিচার পেতে আদালতে সাক্ষী দিতে কয়েক দফায় ভারতে যান ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিচার না পাওয়াটা দুঃখ জনক। ফেলানী হত্যার বিচারের পাশাপাশি সীমান্ত হত্যা বন্ধের দাবি জানাই।

কুড়িগ্রামের পাবলিক প্রসিকিউটর ও ফেলানীর বাবার আইনি সহায়তাকারী অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন জানান, করোনা পরিস্থিতির কারণে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করা রিট পিটিশনটির শুনানি এখনও শুরু হয়নি। বিলম্ব হলেও ন্যায় বিচারের মাধ্যমে দু’দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও শান্তিপূর্ণ সীমান্ত প্রতিষ্ঠা হবে বলে মনে করেন তিনি।

নাগেশ্বরী উপজেলার রামখানা ইউনিয়নের কলনিটারী গ্রামের নুর ইসলাম ও জাহানারা দম্পতির ৮ সন্তানের মধ্যে সবার বড় ছিল ফেলানী। পরিবারের অভাব অনটন দূর করতে কাজের সন্ধানে সপরিবারে চলে যান ভারতে। মেয়েকে বিয়ে দিতে দালালের মাধ্যমে দেশে ফেরার সময় এ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় ফেলানী।

এই বিভাগের আরও খবর