স্পোর্টস ডেস্ক: যে স্বপ্ন বোনা ছিল মেসির হৃদয়ের পাতাল ছায়ায়, যে চাওয়া দাবি হয়ে তারিয়ে বেরিয়েছিল আর্জেন্টিনার নিজস্ব জ্যোতির্ময় আড়ালে- লুসাইলের অমর রাত সবকিছুই তুলে দিল মেসি ও আর্জেন্টিনার হাতে। তবে এর আগে এমবাপ্পের সঙ্গে যে অগ্নিপরীক্ষায় তাঁকে নামতে হলো, ফ্রান্সের ৯৭ সেকেন্ডের দুটি গোলের পর মাঠে যে সমুদ্রমন্থন উঠিয়ে তাঁকে অমৃত তুলে আনতে হলো, তাতে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার সাধ্যি বোধ হয় ফুটবল-ঈশ্বরের ছিল না! শেষমেশ ৩-৩ গোলের ম্যাচ টাইব্রেকে ৪-২-এ হারিয়েই ভুবন জয় করল আর্জেন্টিনা। ম্যারাডোনার পর মেসির হাতে বিশ্বকাপ ট্রফি- এ যেন স্রষ্টা ও সৃষ্টির আবেগ আর কৃতজ্ঞতার চূড়ান্ত নিদান।
একটি মুহূর্ত কীভাবে অনন্তকালে রূপান্তর হয়, কীভাবে একটি ছবি আজীবনের ফ্রেম হয়ে যায়- গ্যালারিতে বসে সেটাই দেখছিল ৯০ হাজারের টইটুম্বর লুসাইল। দূর আকাশ থেকে আরেকজনও কি সেটাই দেখছিলেন! বেঁচে থাকলে আজ তাঁকে নিশ্চয় কেউ গ্যালারিতে আটকে রাখতে পারতেন না। মাঠে এসে মেসির কপালে ম্যারাডোনার চুম্বনই প্রথমে পড়ত। ২০১৪ বিশ্বকাপে মেসির কান্না দেখে ঈশ্বরের কাছে বিচার দিয়েছিলেন অবিচার বলে। গতকাল অবশ্য কোনো অবিচার হয়নি। তবে পরীক্ষা দিতে হয়েছিল বারবার। দুই গোলে এগিয়ে থেকেও ধরে রাখা যায়নি। পরপর দুই গোলে ৮১ মিনিটের মধ্যে ফ্রান্সের খেলায় ফেরা। অতিরিক্ত সময়ের ১০৮ মিনিটে মেসির গোলে ফের এগিয়ে যাওয়া, ১১৮ মিনিটে পেনাল্টি থেকে এমবাপ্পের গোল শোধ। শেষ অবধি টাইব্রেকে গিয়েই ফয়সালা। যখন এমিলিয়ানো মার্টিনেজের মতো গোলরক্ষক থাকে, তখন মেসির মতো সব আর্জেন্টাইনের বিশ্বাস ছিল- এবার অন্তত অবিচার হবে না! একটি গোল ঠেকিয়ে সেটিই প্রমাণ করেছেন মার্টিনেজ। কথা রেখেছেন, জীবন দিয়ে হলেও মেসির জন্য বিশ্বকাপ জিতব আমরা।
যদিও শেষের মতো শুরুটা এমন ছিল না। ম্যাচের ২৩ মিনিটেই পেনাল্টি থেকে গোল পেয়েছিলেন মেসি। আলভারেজের কাছ থেকে বল পেয়ে ফরাসি ডি-বক্সে বাঁ দিক থেকে দারুণভাবে ঢুকে পড়েছিলেন ডি মারিয়া। তবে দেম্বেলের ডিফেন্সে ডি-বক্সেই পড়ে যান তিনি। পোলিশ রেফারি পেনাল্টির বাঁশি বাজাতেই বল হাতে কিক নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে নেন মেসি। ফরাসি গোলরক্ষক লরিসকে বিভ্রান্ত করেই হালকা টাচে গোলের দেখা পেয়ে যান তিনি। এর পর মাঝমাঠের পুরো দখলই চলে যায় আর্জেন্টিনার হাতে। ট্যাগলেফিও, ডি মারিয়া, ডি পল আর এনজো ফার্নান্দেজ নির্ভুল সব পাসিংয়ে বলের দখল বজায় রাখেন। ঠিক ওই সময়টাতে এমবাপ্পের বল সাপ্লায়ার গ্রিজম্যানকেও চোখে চোখে রাখেন আর্জেন্টাইনরা। ওদিকে এমবাপ্পের জন্যও ম্যানমার্ক করে থাকে রোমেরোকে দিয়ে। ম্যাচের ৩০ মিনিট পর্যন্ত ৭২ শতাংশ বল মেসিদের দখলে ছিল। বড্ড ক্লান্ত মনে হয়েছিল তখন এমবাপ্পেদের। অন্যদিকে মেসি তখন নিচে নেমে মাঝমাঠ দাপাচ্ছেন। এমনকি কখনও কখনও আরও নিচে নেমে ডিফেন্সও করেছেন। এমন সময়ে তাঁকে ম্যাচের শুরুর দিকে এতটা চঞ্চল দেখা যায় না। ম্যাচের এমন নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই কাউন্টার অ্যাটাক থেকে ৩৬ মিনিটে দারুণ গোল করেন ডি মারিয়া। মাঝমাঠ থেকে মেসির একটি ফ্লিক যায় আলেস্তারের কাছে। তিনি বলটি ক্রস করেন ডি মারিয়াকে। তিন পাসিংয়ে আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় গোল। ডি মারিয়াকে এদিন কেন শুরু থেকে খেলিয়েছেন আর্জেন্টাইন কোচ স্কালোনি, তার প্রমাণ দেন ডি মারিয়া অ্যাটাকিংয়ে বাঁ দিকটা সচল রেখে।
ওদিকে ফ্রান্স কোচ দেশম হতাশ ছিলেন স্ট্রাইকার জিরুদ আর ডিফেন্ডার দেম্বেলের ওপর। দু’জনকে ৪০ মিনিটের পরই তুলে নেন। প্রথমার্ধে আর্জেন্টিনার অমন স্বপ্নিল সময়ের পর গ্যালারির যেদিকটাতে ফ্রান্সের সমর্থকরা বসেছিলেন, সেদিকে যেন আঁধার নেমে আসে। তবে যে দলে এমবাপ্পে রয়েছেন, সে দলের কোচ নিশ্চয়ই হাল ছাড়বেন না। ফাইনালের ‘ফাইনাল’ তো হয় ম্যাচের শেষ ১০ মিনিটে। কোলো মোনাইকে নিজেদের ডি-বক্সে বিশ্রীভাবে ট্যাকল করেন আর্জেন্টিনার ওতামেন্ডি। পেনাল্টির বাঁশি বাজাতে মুহূর্ত দেরি করেননি রেফারি। আর সেই পেনাল্টি থেকে গোল করতেও একদণ্ড দেরি করেননি এমবাপ্পে। হঠাৎ গোল খাওয়া দল ঘোর কাটাতে না কাটাতেই ফরাসি ফুটবলের সেই গতি আর প্লেসিং। কোম্যান-এমবাপ্পে-থুরাম-এমবাপ্পে, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বল চলে যায় আর্জেন্টিনার জালে। ২-২ গোলে সমতার পরও দু’পক্ষের মরিয়া আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে দম বন্ধ অবস্থা তখন গোটা গ্যালারির। মেসির বাঁ পায়ের প্রচণ্ড জোরালো একটি শট ঠেকিয়ে দিয়ে ফরাসি গোলরক্ষক ইঙ্গিত করেন, লড়াইটা এত তাড়াতাড়ি তিনি শেষ হতে দিচ্ছেন না।
আসলে ফুটবল-ঈশ্বরই বোধ হয় চাননি। লড়াইটা তো ছিল আদতেই মেসির সঙ্গে এমবাপ্পের। তিন গোল করে বছর তেইশের এমবাপ্পে মেসির হাত থেকে উত্তরসূরির ব্যাটনটাই যেন নিয়ে রেখেছেন। বিশ্বকাপ হাতছাড়া হলেও দখলে নিয়ে রাখলেন আগামী দিনের মহাতারকা হওয়ার চূড়ান্ত সবকিছুই।