,

স্কুলের শতকোটির জমি সভাপতিকে উপহার!

জেলা প্রতিনিধি, গাজীপুর: টঙ্গীর তুরাগে ঐতিহ্যবাহী কামারপাড়া হাই স্কুলের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আবুল হাশিম। সভাপতি থাকাকালীন স্কুলের নামে থাকা ১৬৪ শতাংশ জমির ওপর নজর যায় তার।

একটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল করবেন বলে জমিটি কিনতে চান তিনি। এর জন্য চাপ দেন স্কুলের তখনকার ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আমিনুল ইসলামকে। প্রধান শিক্ষক এতে রাজি না হওয়ায় তাকে নানা হুমকি দেওয়া হয়। একপর্যায়ে ভয়ে স্কুলই ছেড়ে চলে যান আমিনুল ইসলাম। এরপর ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পান সহকারী শিক্ষক খুরশিদ জাহান।

ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হয়েই ২০১০ সালে খুরশিদ জাহান শতকোটি টাকার এই সম্পত্তি মাত্র ১ কোটি টাকায় বিক্রি করে দেন তখনকার পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি আবুল হাশিমের কাছে। এটিকে বিক্রি না বলে সভাপতির প্রতি প্রধান শিক্ষকের আনুগত্যের উপহার হিসেবে দেখছেন স্থানীয়রা। ওই জমিতে আবুল হাশিম ‘উত্তরা বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল’ নাম দিয়ে একটি সাইনবোর্ড টানিয়ে রাখেন। তবে আজ পর্যন্ত এই হাসপাতাল সেখানে নির্মাণ হয়নি।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জমি বিক্রির ওই টাকা দিয়ে সভাপতি আবুল হাশিম স্কুলটিকে কলেজে রূপান্তর করেন। কামারপাড়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামকরণ করে খুরশিদ জাহান নিয়মবহির্ভূতভাবে রাতারাতি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বনে যান।

কামারপাড়া এলাকায় বর্তমানে জমির মূল্য কেমন—জানতে চাইলে স্থানীয় দলিল লেখক ইয়াকুব জানান, বর্তমানে কামারপাড়ায় প্রতি শতাংশ জমির মূল্য ১৪ লাখ হলেও শতাংশে প্রায় কোটি টাকা ধরে কেনাবেচা হচ্ছে। এ হিসাবে স্কুলের ওই জমির বর্তমান মূল্য দুইশ কোটি টাকার কাছাকাছি।

ঢাকা সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিস ও বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৭ সালে স্থানীয় আক্কাছ আলী ও বাবুর আলীর কাছ থেকে ১৬৪ শতাংশ জমি ক্রয় করে কামারপাড়া হাই স্কুল কর্তৃপক্ষ। যার সাফ কবলা দলিল নং ৬৫৫ ও ৫৫২। ঢাকা সিটি জরিপে স্কুলের নামে এ জমি রেকর্ডভুক্তও হয়। পরে ২০১০ সালে স্কুলের সভাপতি আবুল হাশিমের উত্তরা বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কাছে বিক্রি করে দেন স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক খুরশিদ জাহান।

কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বিধিবহির্ভূতভাবে এ জমি নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে। ২০২১ সালে আবুল হাশিম মারা যান। তিনি মারা যাওয়ার পর অ্যাডহক কমিটি গঠিত হয়। কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আবদুল বারিক। ছয় মাস পর আবার অ্যাডহক কমিটি পরিবর্তন হয়। এবার সভাপতি হন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর হোসেন যুবরাজ। ২০২৩ সালে আবার সভাপতি হন মৃত আবুল হাশিমের ছেলে মহিবুল হাছান। কলেজের অধ্যক্ষ খুরশিদ জাহানসহ এ পর্যন্ত পরিচালনা পর্ষদে থাকা সবার বিরুদ্ধেই রয়েছে দুর্নীতি ও নানা অনিয়মের অভিযোগ।

গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তন হলে এই প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক ভাঙচুর হয়। অধ্যক্ষের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় এলাকাবাসীও। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রথমে প্রতিষ্ঠান ও পরে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ খুরশিদ জাহান। জনরোষে পরিচালনা পর্ষদের সভাপতিসহ অন্য সদস্যরাও আত্মগোপনে চলে যান।

পলাতক থাকায় সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ খুরশিদ জাহানের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা যায়নি। অভিযোগের বিষয়ে কথা বলার জন্য তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন দিলেও নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে তাকে এসএমএস দিলেও কোনো সাড়া দেননি।

গত ১৫ বছর আগে স্কুল ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আমিনুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। কোনো শিক্ষক কাউকে স্কুলের সম্পত্তি লিখে দিতে পারেন কি না-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সরকারি নির্দেশনা থাকলে প্রধান শিক্ষক জমি লিখে দিতে পারেন। তিনি বলেন, ‘তৎকালীন সভাপতি আবুল হাশিম বারবার আমাকে জমি লিখে দিতে বলায় আমি তখন রাজি হইনি। পরে তার হুমকিতে এলাকা ছেড়ে চলে আসি। দুই মাস পর চাকরি থেকে রিজাইন দিই।’

এদিকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পালিয়ে গেলে গত ৩ সেপ্টেম্বর তার স্থলাভিষিক্ত হন প্রতিষ্ঠানটির কৃষিবিষয়ক প্রভাষক রেহেনা পারভীন।

রেহেনা পারভীন বলেন, ‘মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরসহ যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো জমি বিক্রি করা যায় না। এই প্রতিষ্ঠানের জমি বিক্রিসহ গত ১৫ বছরে অনেক অনিয়ম হয়েছে। সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ খুরশিদ জাহানসহ যারাই এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় আনাই হবে আমার প্রথম কাজ। পাশাপাশি গভর্নিং বডি ও স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় শিগগির আমাদের স্কুল ও কলেজের জমি উদ্ধার করব ইনশাআল্লাহ।’

সম্প্রতি ঘটনাস্থলে গিয়ে জানা যায়, ওই জমির একটি অংশ সাড়ে ১০ কাঠা দখল করে নেন স্থানীয় বিএনপি নেতা জহিরুল ইসলাম। এই জমি আবার তিনি বিক্রি করে দেন ইস্টওয়েস্ট মেডিকেল কলেজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে। গত ৫ আগস্টের পর রাতারাতি এ জমিতে মাটি ভরাট করে শেড নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, নির্মাণকাজ চলছে দ্রুতগতিতে। এ বিষয়ে জানার জন্য জহিরুল ইসলাম ও ইস্টওয়েস্টের দায়িত্বশীল কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। জহিরুল ইসলামের মোবাইল নম্বরে বারবার ফোন দিলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

এই বিভাগের আরও খবর