,

যে উপজেলায় এমবিবিএস ডাক্তার ও হাসপাতাল নেই!

বিডিনিউজ ১০ ডটকম ডেস্ক: নদী আর সাগর বেষ্টিত জনপদ রাঙ্গাবালী উপজেলায় দেড় লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। ৬ বছর আগে এই জনপদকে উপজেলায় উন্নীত করা হয়। কিন্তু উপজেলাবাসীর চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে দীর্ঘদিনেও সেখানে সরকারি হাসপাতাল গড়ে ওঠেনি। তাই একজন এমবিবিএস ডাক্তার পর্যন্ত নেই। ফলে সেখানকার মানুষের হাতুরে ডাক্তার-কবিরাজ কিংবা আদিকালের চিকিৎসার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।

অবহেলিত এ উপজেলার অবস্থান পটুয়াখালী জেলা সদর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে। একমাত্র নদীপথ কেন্দ্রিক এ উপজেলার যোগাযোগ। এটির উত্তরে আগুনমুখা, পশ্চিমে রামনাবাদ, পূর্বে বুড়াগৌরাঙ্গ ও দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর।

২০১২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাঁচটি ইউনিয়ন নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এ উপজেলার প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু দীর্ঘ ৬ বছর অতিবাহিত হলেও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ হয়নি। তাই এমবিবিএস ডাক্তারও নেই। এর ফলে এ জনপদের দেড় লক্ষাধিক মানুষের হাতুরে ডাক্তার, হেকিম-কবিরাজ, বাইদা ও ক্যানভাসারের তাবিজ-কবজের ওপর ভরসা করতে হচ্ছে।

উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের কোড়ালিয়া বাজার। সেখানকার রাজু মেডিসিন কর্নার নামের ঔষধের ফার্মেসিতে চিকিৎসা নিতে আসা একই এলাকার জেলে ঝিলাম হোসেনের (২৮) সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়।

তিনি বলেন ‘দুই-তিন বছর ধইরা মাথা ব্যাথা। শরীর সব সময় অস্থির লাগে। হাত-পা কাইপ্পা মাঝে মাঝে অজ্ঞান হইয়া যাই। কবিরাজ তেল দিছে, মালিশ করি। কোন কাজ ওয় (হয়) নাই। আমাগো এলাকায় তো হাসপাতাল নাই। বড় ডাক্তারও (এমবিবিএস) নাই যে, হেরে দ্যাহামু। শহরে গিয়া ডাক্তার দ্যাহানোর সামর্থ নাই। এহন এইহানের ফার্মেসি দিয়া প্রেত্যেক দিন ঔষধ নিয়া খাই। কপালে যা আছে হেইয়াই ওইবে।’

উপজেলা সদর থেকে নদীপথে ২০ কিলোমিটার দূরে চরমোন্তাজ ইউনিয়নের স্লুইস বাজার। সেই বাজারের মেসার্স রিপন মেডিকেল নামের এক ফার্মেসিতে চিকিৎসা নিতে বাচ্চা কোলে নিয়ে আসে নাজমা বেগম।  ওই নারী বলেন, ‘ছেলে জন্মের পর থেকেই শারীরিক অসুস্থতা। শরীর দুর্বল লাগে। মাঝেমাঝে অসুস্থ হয়ে পরি। হেকিমের সালশা খাইছি। তাতেও ভালো বুঝি না। তাই ডাক্তার দ্যাহাইতে আইছি।’

এভাবে শুধু এই দুই এলাকাতেই নয়, উপজেলায় দেড় শতাধিক অনুমোদনবিহীন ফার্মেসির গ্রাম্য হাতুরে ডাক্তারদের ওপর ভরসা করছে লোকজন। যদিও রোগী দেখার জন্য অনেকেরই নেই কোন অনুমতি কিংবা ডিগ্রি। তবুও তারা রোগী দেখে ওষুধ বিক্রি করছে। একই সঙ্গে এসব এলাকায় হেকিম-কবিরাজ, বাইদা ও ক্যানভাসাররা তাবিজ-কবজ দিয়ে চিকিৎসা চালাচ্ছে।

উপজেলাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি-এ উপজেলায় অন্তত ৫০ শয্যা বিশিষ্ট একটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হোক। স্থানীয়রা জানান, এ উপজেলার লোকজনের ভয়াল নদী পাড়ি দিয়ে দেশের যে কোন প্রান্তে যেতে হয়। একজন মুমূর্ষু রোগীকে জেলা সদরে নিতে সময়ও লেগে যায় প্রায় ৬-৭ ঘন্টা। তাও অনেক সময় খেয়া কিংবা লঞ্চ সময় মতো না পেলে দুর্ভোগের আর কোন শেষ থাকে না।

লঞ্চের সময় চলে গেলে একমাত্র ভরসা ইঞ্জিনচালিত ট্রলার। এতে সময় লাগে আরও বেশি। খরচও হয় প্রচুর। সময়মতো হাসপাতালে পৌঁছাতে না পেরে অনেকের মৃত্যুও হয়। বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের জন্য ভোগান্তি হয় সবচেয়ে বেশি।

যেভাবে চলছে এ এলাকার চিকিৎসা

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯১ সালের পরে উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের মধ্যে রাঙ্গাবালী, ছোটবাইশদিয়া ও চরমোন্তাজে একটি করে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হলেও বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নে হয়নি। চালিতাবুনিয়া ইউনিয়নে একটি আরডি (রুরাল ডিসপেনসারি) থাকায় ওখানেও কোন চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি।

এ কেন্দ্রগুলোতে চলছে নামমাত্র চিকিৎসা। এতে নেই কোন এমবিবিএস ডাক্তার। এমনকি অস্ত্রোপচারের বা প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই।

আর বেশিরভাগ সময়ই ওইসব কমিউনিটি ক্লিনিক বন্ধ থাকে। যার ফলে ওইসব ক্লিনিকেও সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সোহাগ হাওলাদার বলেন, ‘যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এই উপজেলায় একটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স খুব জরুরি। হাসপাতালের প্রশাসনিক অনুমোদনের জন্য জেলা থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে। তবে জমি অধিগ্রহণ এখনও হয়নি।’

রাঙ্গাবালী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘দুর্গম এই উপজেলাবাসীর চিকিৎসা সেবার কথা চিন্তা করে জরুরি ভিত্তিতে একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ করা দরকার। আশা করছি, খুব দ্রুত এখানে হাসপাতাল হবে।’

এ ব্যাপারে পটুয়াখালী সিভিল সার্জন ডা. শাহ মো. মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ইতিমধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং হেলথ ডিপার্টমেন্টের ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে আমি রাঙ্গাবালী পাঠিয়েছিলাম। এই অর্থবছরেই একটা কিছু সুফল পাওয়া যেতে পারে। এ বিষয়ের কাজ অগ্রসর হচ্ছে।’

 

এই বিভাগের আরও খবর