,

মেয়ে তোমার জীবন পরজীবী স্বর্ণলতা নয়

প্রতীকী ছবি

হাসিনা আকতার নিগার

দিন শেষে প্রতিটি মানুষ তার আপন ভুবনে নিজেকে খুঁজে পেতে চায় নিজের মত করে। কিন্তু পরিবার কেন্দ্রিক জীবনে একজন নারী নিজেকে নিয়ে একান্তভাবে স্বীয় ভাবনার জগত তৈরি করতে পারে না। যার ফলে  তার স্বকীয়তা বা নিজস্ব সত্তা  বলে কিছু থাকে না। এমনকি সে নিজের মানসিক শারীরিক খেয়াল পর্যন্ত রাখতে পারে না ঠিকভাবে। কারণ তার সারাটা সময় বরাদ্দ থাকে ঘর সংসার, স্বামী সন্তান পরিজনের জন্য।

যদিওবা আধুনিকালে নারীরা নিজেদের মেধা ও মননশীলতা দিয়ে বিকশিত হচ্ছে সারা দুনিয়াতে। তথাপি নারী হিসাবে তাদের মাঝে রয়েছে একটা পরনির্ভরশীলতা ছাপ। এর পেছনে কারণ হিসাবে নিরাপত্তাহীনতা, আস্থার অভাব, সামাজিক ধ্যান-ধারনা অনেকাংশে দায়ী। ফলশ্রুতিতে দেখা যায়  আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়েও আজো অধিকাংশ নারীর চিন্তা চেতনাতে সেই সাবেকী আমলের মত। যে কারণে স্বামীর উপর নির্ভরশীল কোন নারীর গৎ বাঁধা  জীবনের হিসাবে ভুল হলেই সে ভেঙে পড়ে মানসিকভাবে। কিংবা নীরবে ফেলে চোখের জল।

এহেন পরিস্থিতিতে সতী সাবিত্রী স্ত্রীর ভূমিকা পালন করতে করতে যে মেয়েটি ভুলে গেছে তার নিজের অস্তিত্ব, সে কি পারবে ঘুরে দাঁড়াতে? এমন চিন্তাতে শঙ্কিত হয়ে হাজারো নারী এ সমাজে মুখ বুজে সয়ে যায় স্বামীর সংসারের মানসিক শারীরিক নির্যাতন।এক সময় যে পুরুষটিকে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরুষ মনে করত, একদিন দেখল সে পুরুষটি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তার থেকে। প্রেম ভালোবাসা মিথ্যা হয়ে যায় এক নিমেষে। মনোজগতে দুজনের যোজন যোজন মাইল ব্যবধান।ভেঙে যায় দুজনের বিয়ে নামের সর্ম্পক। নারীটির জীবনে যাকে ঘিরে সব কিছু সে পুরুষটি হয়তবা খুঁজে নিয়েছে নতুন কোন প্রেয়সীকে। আর এমন অবস্থায় সাধারণত সকল ভুল ত্রুটির জন্য মেয়েটিকে দায়ী করতে অভ্যস্ত পরিবার সমাজ। কারণ স্বামীর মন জুগিয়ে চলাই যে তার একমাত্র দায়িত্ব- এটাই এখনো প্রচলিত ধারণা সমাজের। আর স্বামীটি ও তার অন্যায় আচরণকে হালাল করতে সব কিছুতে দোষ খুঁজে ঘরের নারীটির। এতে করে সত্য মিথ্যার মিশেলে জীবনে আসে বৈরি পরিবেশ।

অভাগা মনে করে নারী ও সে পরিবেশে সংসারে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু সে বুঝতে পারে না বটবৃক্ষের সাথে জড়িয়ে থাকা স্বর্ণলতার মত সে স্বামীর সাজানো সংসারে পরজীবী প্রাণি কেবলমাত্র। স্বর্ণলতাকে যেমন গাছ থেকে উপড়ে ফেলে দিলে হয়ে যায় অস্তিত্বহীন। তেমনি স্বামীও স্ত্রীকে উপেক্ষা করলে এই নির্ভরতা হারিয়ে যায়।

জীবনে মানুষ হিসাবে বাঁচতে গিয়ে স্বর্ণলতা হলে চলবে না নারীকে । কিন্ত শামুকের খোলসের আড়ালে যে মুক্তো থাকতে পারে, তা পরনির্ভরশীল সে নারী  চিন্তা করতে পারে না। ভয় পায় ঘরের বাইরের জীবনটাকে। অবশ্যই চলার পথে বাঁধা আছে। আর নারীদের জন্য সে পথ আরও কঠিন। তবে মানুষ হিসাবে বাঁচতে হলে প্রতিকূল পরিবেশে লড়াইটা করতে হয় নিজেকে। সেখানে মানসিকভাবে আত্মনির্ভরশীলতা সবার আগে প্রয়োজন।

এমন ভাবনাগুলো মনকে নাড়া দিলেও স্বামীর সাথে বিদ্রোহ করে আসার সাহসটুকু পায় না অনেক নারী। বাবা মায়ের পরিবারের কাছে বলতে পারেনা একান্ত কষ্টের কথা। ক্রমশ বাড়তে থাকে শারীরিক মানসিক নির্যাতন। শঙ্কায় কাটে অনাগত দিনগুলোর ভয়াবহতা নিয়ে। নিজের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে যায়। একা পথ চলার ভয়ে হয়তবা আবারও খুঁঁজে একটা আশ্রয়। তবু এটা বুঝতে চায় না যে, পরনির্ভরশীল নারী থেকে নিজেকে আত্মনির্ভর নারীতে পরিণত করার  শিক্ষাটা নিজেকেই নিতে হয় জীবন থেকে।

কারণ আমাদের সমাজে ছোটবেলা থেকে মেয়েদেরকে আত্মনির্ভরশীলতা হয়ে উঠার চেয়ে স্বামী নির্ভর জীবনের কথা শুনিয়ে বড় করে। এতে করে খুব কম মেয়েই জানতে পারে, তার যে নিজের একটা জীবন আছে। প্রেম ভালোবাসার সাথে সমঅধিকার নিয়ে স্বামী স্ত্রী একে অপরের পরিপূরক হয় থাকার নাম সংসার। নারীর জন্য সংসার কোন বন্দী জীবন হতে পারে। মুক্ত আকাশে বাঁচার জন্য ভালোবেসে ঘর বাঁধে দুজন মানুষ। সেখান যদি ভালোবাসার চোরকাঁটা বিঁধে বিষাদের ছায়া নেমে আসে তবে জোড়াতালি দিয়ে দুজন চলতে পারে না।  সে ঘরের সন্তানদের জীবনে নামে বির্পযয়। সে ক্ষেত্রে নতুন করে নিজের মত বাঁচার পথটাই বেছে নেয়া উত্তম। আর তখন এ সমাজে স্বামীবিহীন নারীটির হয়ে যায় একা। নিজেকে নিজের আগলে রাখতে হয়।

প্রেম ভালোবাসার কাব্যময় রাতের পর দিনের আলোর বাস্তবতা বড় কঠিন। কারন স্রোতের বিপরীতে হাঁটতে গেলে বিগত পরগাছা জীবন সামনে এসে দাঁড়ায় নানাভাবে। মুক্তি কি তার হয়েছে? এ প্রশ্নে আবেগ তাড়িত হয় মন।

সংসার কি ভালোবাসা না মোহ? নিজের মত জীবনকে বুঝতে গিয়ে  উত্তর মিলে না এর। ভালোবাসা তো নিয়ম মানে না। কিন্তু মোহ বলেই সংসারের বাইরে পা রাখতে সমাজকে ভয় পায় নারী। জীবন বোধের অজ্ঞতা থেকে এক ভুলে সারা  জীবন কাটিয়ে দেয় সারা জীবন। বঞ্চিত হয় নিজের মত করে বাঁচার অধিকার থেকে।

জীবনটা হলো একটা ব্ল্যাকবোর্ডে। এখানে ভুল লেখাগুলোকে শুধরে নিতে হবে।  সামনের দিকে এগিয়ে যাবার নামই জীবন। নারী বলে চার দেয়ালের বাইরে তার জীবন সত্তা থাকবে না তা কিন্তু নয়।

প্রেম ভালোবাসা আবেগ জীবনকে কেবল পরাজিত হতে শিখায় না। বরং কখনও কখনও আবেগের কাছে থেকেই জীবনবোধের ধারনা আসে নতুন আঙ্গিকে।

নারী হয়ে কেন শুধু বাঁচতে হবে স্বামী সন্তান কিংবা পরিবার পরিজনের জন্য। মুক্ত আকাশে প্রাণ খুলে শ্বাস নিতে হলে নিজের জন্য বাঁচতে হবে আপন সত্তা নিয়ে। আর কেউ তাকে পরিত্যাগ করছে তেমন ভাবনাকে দূর করে দিতে হবে । বরং বহুরূপী সে পুরুষকে নিজেরই পরিত্যাগ করা উচিত

জীবনের বাঁকে বাঁকে থাকবে কত মিথ্যা মোহের হাতছানি। সে মিথ্যাকে সরিয়ে আত্মনির্ভরশীল হয়ে বিকশিত হলেই নারীরা খুঁজে পাবে জীবনের আস্বাদন।

তাই নারীকে কেবল নারী নয়। বরং মানুষ হিসাবে শুধু একবার নিজের জন্য বাঁচার লড়াইটা করতে হবে। বঞ্চনা সহে কারো জীবনে পরজীবী হয়ে থাকা আর নয়। আর তার জন্যই নিজের বন্ধ ঘরের চাবি নিজেকেই ভাঙতে হবে সাহস করে আপন আলোয় আলোকিত হয়ে।

লেখক-ফিচার লেখক।

 

 

এই বিভাগের আরও খবর