,

করোনা পলিটিক্স বনাম হৃদয় দিয়ে সেবা

মো. ফিরোজ মিয়া: করোনা নিয়ে পলিটিক্স নয়, দোষারোপের রাজনীতি নয়। একপক্ষ কেবল সফলতার বা আত্মতুষ্টির গল্প বলবে, অন্যপক্ষ কেবল ব্যর্থতার বা নিরাশার গল্প বলবে, এখন তা কাম্য নয়।

এখন সময় সবার এগিয়ে আসার, মানবিক হওয়ার এবং হৃদয় দিয়ে সেবা করার। কেননা আমরা জানি না ইউরোপ ও আমেরিকার মতো আমাদের দেশেও করোনা নির্দয়ভাবে হানা দেবে; নাকি প্রকৃতি আমাদের প্রতি সদয় হবে!

ইতোপূর্বে যতগুলো মহামারী বা বৈশ্বিক মহামারী দেখা দিয়েছে, সেসবের তুলনায় করোনা অতিমাত্রার দ্রুত এবং ভয়াবহ ছোঁয়াচে। বর্তমান বিশ্বের উন্নততর যোগাযোগ ব্যবস্থা করোনার দ্রুত বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

এছাড়া করোনার ভয়াবহতা এবং আতঙ্কও অনেক বেশি। অতিদ্রুত বিশ্বের প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১১ মার্চ ২০২০ তারিখে করোনাকে ‘প্যানডেমিক’ ঘোষণা করেছে।

এ বৈশ্বিক মহামারীর ভয়াবহতা এবং এর পরিণতি সম্পর্কে ধারণার জন্য ‘এপিডেমিক’ ও ‘প্যানডেমিক’ বিভিন্ন যুগে মানব ইতিহাসে যে করুণ কালো অধ্যায় রচনা করেছে, সে সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেয়া দরকার।

সাধারণভাবে সংক্রামক ব্যাধিতে ব্যাপক মৃত্যুই এপিডেমিক বা মহামারী এবং এ মহামারী যখন কোনো একটি অঞ্চলের বা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিভিন্ন অঞ্চল ও দেশে ছড়িয়ে পড়ে, তখন তাকে বলা হয় প্যানডেমিক বা বৈশ্বিক মহামারী। এপিডেমিক এবং প্যানডেমিক দুটি শব্দই গ্রিক শব্দ।

হোমারের ওডিসি উপকথায় সর্বপ্রথম এপিডেমিক শব্দটি ব্যবহৃত হয়। পরে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে গ্রিক চিকিৎসাবিদ হিপোক্র্যাটস তার চিকিৎসা শাস্ত্রে প্রথম এ শব্দটি ব্যবহার করেন, যা এখন বহুল ব্যবহৃত।

প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই মানুষ এপিডেমিক ও প্যানডেমিক দ্বারা আক্রান্ত হয়ে আসছে। জানামতে, কমপক্ষে বিশটি মারাত্মক এপিডেমিক ও প্যানডেমিক মানবজাতিকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে ইতিহাসও পাল্টে দিয়েছে।

পাঁচ হাজার বছর আগের চীনের হেমিন মেঙ্গা, চারশ’ ত্রিশ খ্রিস্টপূর্বের এথেন্সের মহামারী, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীর রোমের মহামারী, চতুর্দশ শতাব্দীর ব্লাক ডেথ বৈশ্বিক মহামারী, ষষ্ঠ শতাব্দীর জাস্টিয়ান বৈশ্বিক মহামারী, ষোড়শ শতাব্দীর মেস্কিকো ও মধ্য আমেরিকার কোকোলিজটলি মহামারী, ষোড়শ শতাব্দীর আমেরিকান মহামারী, সপ্তদশ শতাব্দীর লন্ডন মহামারী, অষ্টাদশ শতাব্দীর ফ্রান্সের মার্সাইল মহামারী, অষ্টাদশ শতাব্দীর রাশিয়ার বৈশ্বিক মহামারী, বিংশ শতাব্দীর স্প্যানিশ ফ্লু ও এশিয়ান ফ্লু বৈশ্বিক মহামারী, একবিংশ শতাব্দীর ইবোলা ভাইরাস, ঝিকা ভাইরাস মহামারী এবং এইচআইএনআই সোয়াইন ফ্লু বৈশ্বিক মহামারী ইত্যাদি।

এছাড়াও গুটিবসন্ত বৈশ্বিক মহামারীর উল্লেখ করা যায়, যার উৎপত্তি ১২ হাজার বছর আগে হলেও বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এ মহামারী বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। এছাড়া বিগত ২০০ বছরে সাতটি কলেরা বৈশ্বিক মহামারী এ উপমহাদেশসহ বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে; যার মধ্যে ১৮১৭ সালের ইন্ডিয়ান বৈশ্বিক কলেরা মহামারী, বিংশ শতাব্দীর দক্ষিণ আমেরিকা ও এই উপমহাদেশের বৈশ্বিক কলেরা মহামারী উল্লেখযোগ্য।

এসব মহামারী এবং বৈশ্বিক মহামারী অসংখ্য প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। এথেন্সের মহামারীতে লক্ষাধিক, ব্লাক ডেথ মহামারীতে ইউরোপ মহাদেশের এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ প্রায় দুই কোটি লোক মারা যায়। স্পেনিশ ফ্লুতে বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ লোক অর্থাৎ প্রায় পঞ্চাশ কোটি লোক আক্রান্ত হয় এবং দুই থেকে পাঁচ কোটি লোক মারা যায়, সোয়ান ফ্লুতে বিশ্বের প্রায় ১১-২১ শতাংশ অর্থাৎ সত্তর কোটি থেকে ১৪০ কোটি লোক আক্রান্ত হয় এবং দেড় লাখ থেকে পৌনে ছয় লাখ লোক মারা যায়।

বৈশ্বিক গুটিবসন্ত মহামারীতে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে প্রতি বছর প্রায় চার লক্ষাধিক লোক মারা যায় এবং ১৯৮০ সালে রোগটি সম্পূর্ণ নির্মূল হওয়ার আগে কেবল বিংশ শতাব্দীতেই কেড়ে নিয়েছিল ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ কোটি লোকের জীবন।

এছাড়া ১৮১৬ থেকে ১৯৬১ এ সময়ের মধ্যে সাতটি বৈশ্বিক কলেরার মধ্যে প্রথম ছয়টি বৈশ্বিক মহামারীতে কেবল ভারতেই প্রায় দুই কোটি আশি লাখ লোক মারা যায়। এ পরিসংখ্যান থেকে আমরা মহামারী এবং বৈশ্বিক মহামারীর ভয়াবহতা আঁচ করতে পারি।

অন্যান্য বৈশ্বিক মহামারীর চেয়ে করোনা অত্যন্ত মারাত্মক রকমের ছোঁয়াচে এবং অতিদ্রুত সংক্রামক; যার কারণে অতিদ্রুততার সঙ্গে যথাযথ পদক্ষেপের দ্বারাই কেবল এর ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

কিন্তু আমরা দ্রুততার সঙ্গে সঠিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সক্ষম না হওয়ায় করোনার কালো থাবা সম্প্রসারিত হচ্ছে। অন্যান্য বৈশ্বিক মহামারীর মতো করোনা মোকাবেলার জন্যও প্রয়োজন ছিল অতিদ্রুত যথোপযুক্ত মহাকর্মপরিকল্পনা গ্রহণের।

এ মহাকর্মপরিকল্পনা তিন স্তরবিশিষ্ট। প্রথম স্তরের কর্মপরিকল্পনা হল মহামারী প্রতিরোধের, দ্বিতীয় স্তরের কর্মপরিকল্পনা হল মহামারী নিয়ন্ত্রণের এবং তৃতীয় স্তরের কর্মপরিকল্পনা হল অর্থনৈতিক গতিশীলতার।

অতীত ইতিহাস থেকে যতটা জানা যায়, করোনার অনুরূপ মহামারীর স্থায়িত্ব কমপক্ষে এক থেকে তিন বছর। এজন্য কমপক্ষে তিন বছর সময়সীমা সামনে রেখেই করোনা নিয়ন্ত্রণের সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের প্রয়োজন হবে।

এ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে কিছু বিষয়কে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। যেমন, সঙ্গনিরোধমূলক কার্যক্রম, সাপোর্টিভ কেয়ারসহ চিকিৎসাসেবার পরিধি বৃদ্ধি এবং স্বাভাবিক রোগের চিকিৎসা অব্যাহত রাখা, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও মানবিক চেতনা জাগরণসহ মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি।

এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সাময়িক ক্ষতির বিষয়কে অধিক গুরুত্ব দেয়া কোনোক্রমেই উচিত হবে না। কারণ জীবনের চেয়ে অর্থনীতি বড় নয়। চীনসহ যেসব দেশ ভবিষ্যৎ সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক ক্ষতির কথা চিন্তা করে সাময়িক অর্থনৈতিক ক্ষতিকে গুরুত্ব না দিয়ে করোনা নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, সেসব দেশ করোনার বিস্তার অনেকটা নিয়ন্ত্রিত রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু যেসব দেশ সাময়িক অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে ঢিলেঢালা কার্যক্রম গ্রহণ করেছে, তারা এখন চরম বিপর্যয়ের মুখে।

করোনা চিকিৎসার কার্যকরী ও বিশ্বাসযোগ্য ওষুধ বের হওয়ার আগ পর্যন্ত এ থেকে বাঁচার বা সুরক্ষার একমাত্র উপায় সঙ্গনিরোধের মাধ্যমে নিজের এবং অন্যের আক্রান্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

সঙ্গনিরোধ বা সামাজিক দূরত্ব কার্যকর করার ক্ষেত্রে সচেতনতা সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। জনমনে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ধর্মীয় অনুশাসনের প্রচার এবং দেশের আলেম সমাজসহ অন্যান্য ধর্মীয় গুরুদের সম্পৃক্ত করা একান্ত আবশ্যক।

কারণ মানুষ নিরুপায় হলে ধর্ম এবং ধর্মীয় গুরুদের শরণাপন্ন হয়, তাদের বিশ্বাস করে। একই সঙ্গে প্রয়োজন গুজব প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম গ্রহণের। এজন্য প্রতিটি গুজবের বিষয়ে সঠিক তথ্য প্রচারের কোনো বিকল্প নেই।

সাধারণত অপর্যাপ্ত প্রকৃত তথ্যই গুজবের জন্ম দেয়। গুজবকে কঠোরভাবে মোকাবেলা করতে হবে। প্রতিটি গুজবের বিষয়ে প্রকৃত সত্য তুলে ধরে এর ব্যাপক প্রচার করতে হবে। প্রকৃত ঘটনাকে গুজব হিসেবে উড়িয়ে দিলে বা আড়াল করা হলে এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে।

কারণ তা প্রকৃত ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের মাঝে মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে এবং আস্থার সংকট সৃষ্টি করবে, যা করোনার চেয়েও দ্রুতগতিতে সমাজে বিস্তার লাভ করবে। তখন মানুষ সরকারের বক্তব্যকে বিশ্বাস না করে গুজবকে বিশ্বাস করতে আরম্ভ করবে।

করোনার সংক্রমণ দীর্ঘায়িত হলে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে, কৃষি উপকরণের ঘাটতি দেখা দিতে পারে, মুনাফালোভীরা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করতে পারে। এজন্য কৃষি উপকরণের বিষয়ে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন হবে।

কৃষি উপকরণ সহজলভ্য করার সঙ্গে সঙ্গে বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে প্রান্তিক কৃষকদের মধ্যে দুর্নীতিমুক্তভাবে বিতরণের ব্যবস্থা করতে না পারলে দেশ খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হতে পারে।

মো. ফিরোজ মিয়া : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব, চাকরি ও আইন সংক্রান্ত গ্রন্থের লেখক

এই বিভাগের আরও খবর