,

মেট্রোরেল : ৪০ মিনিটে উত্তরা থেকে মতিঝিল

ফাইল ফটো

নিজস্ব প্রতিবেদক: পদ্মা সেতুর মতো আরেকটি মেগা প্রকল্প স্বপ্নের মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলছে পুরোদমে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২১ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে সময় লাগবে ৪০ মিনিটের চেয়েও কম। প্রতি ৪ মিনিট পর পর ১ হাজার ৮০০ যাত্রী নিয়ে চলাচল করবে মেট্রোরেল। ঘণ্টায় প্রায় ৬০ হাজার যাত্রী বহন করা হবে।

মেট্রোরেলের কোচ হবে লাল-সবুজ রঙের। একটি ট্রেনের কোচ থাকবে ৬টি। সম্পূর্ণ বৈদ্যুতিক ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হবে মেট্রোরেল। প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)।

প্রকল্পের সূত্রে জানায়, প্রতিটি ট্রেনে স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছয়টি বগি থাকবে। বগির উভয় পাশে চারটি দরজা থাকবে। ট্রেনে সিটের ধরন হবে লম্বালম্বি এবং প্রতি ট্রেনে ২টি হুইল চেয়ার থাকবে। এছাড়া থাকবে স্মার্টকার্ড টিকিটিং পদ্ধতি। রাস্তার মাঝ বরাবর ওপর দিয়ে মোট ২৪ জোড়া মেট্রোরেল চলাচল করবে ঢাকায়।

উত্তরা থেকে শুরু হয়ে মিরপুর-ফার্মগেট হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত যাবে এই মেট্রোরেল। সময় লাগবে ৪০ মিনিটেরও কম। মোট ১৬টি স্টেশন হবে মেট্রোরেলের। এগুলো হবে- উত্তরা (উত্তর), উত্তরা (সেন্টার), উত্তরা (দক্ষিণ), পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০ নম্বর, কাজীপাড়া, তালতলা, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, সোনারগাঁও, জাতীয় জাদুঘর দোয়েল চত্বর, জাতীয় স্টেডিয়াম এবং বাংলাদেশ ব্যাংক এলাকায়। মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা লাগবে; এর মধ্যে ১৬ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা দেবে জাইকা। বাকি ৫ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা জোগাবে সরকার। ২০১২ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) এ প্রকল্প অনুমোদন পায়।

ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি-৬) প্রকল্পের আওতায় ৮টি প্যাকেজে নির্মাণ করা হচ্ছে মেট্রোরেল। এর মধ্যে ১ নম্বর প্যাকেজের আওতায় দিয়াবাড়ি এলাকায় ডিপো এলাকার ভূমি উন্নয়নের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালের অক্টোবরে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে এর কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। ডিপো এলাকার পূর্ত কাজ করা হচ্ছে প্যাকেজ-২ এর আওতায়। এর মধ্যে ডিপোতে ট্রেন রাখার স্থান, ট্রেন মেরামত ও মালামালের গুদাম, প্রধান ওয়ার্কশপসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণ কাজ করা হচ্ছে। ২০১৭ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া এই প্যাকেজের বর্তমান অগ্রগতি ১৭ শতাংশ। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার উড়ালপথ ও ৯টি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে ৩ ও ৪ নাম্বার প্যাকেজে। ২০১৯ সালের জুনে এই প্যাকেজের কাজ শেষ হওয়ার কথা। এ পর্যন্ত এই প্যাকেজের অগ্রগতি ৩০ শতাংশ।

এছাড়া আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ভায়াডাক্ট (উড়ালপথ) এবং স্টেশন নির্মাণকাজ হচ্ছে প্যাকেজ ৫ এবং ৬ এর অধীনে। এ দুটি প্যাকেজের বাস্তব কাজ এখনও শুরু হয়নি। তবে পুরো প্রকল্প এলাকায় ভূমি জরিপ শেষ হয়ে গেছে। প্রকল্পের বৈদ্যুতিক এবং মেকানিক্যাল সিস্টেম বাস্তবায়ন হচ্ছে ৭ নম্বর প্যাকেজের আওতায়। এ প্যাকজের আর্থিক প্রস্তাব মূল্যায়ন প্রতিবেদন জাইকার সম্মতির জন্য পাঠানো হয়েছে। রেলের কোচ এবং ডিপোর যন্ত্রপাতি সংগ্রহের কাজ হচ্ছে প্যাকেজ ৮-এর অধীনে।

এ প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি ৯ ভাগ বলে প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে। প্রকল্পের বিভিন্ন পর্যায়ে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ১২টি জরিপ কাজের সবগুলোই শেষ হয়েছে। উত্তরা থেকে শাহবাগের বারডেম হাসপাতাল পর্যন্ত প্রকল্পের পরিষেবা স্থানান্তর (ইউটিলিটি রিলোকেট) হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রথম মেট্রো ট্রেনের সামনের ও পেছনের নকশা এবং বাইরের রং চূড়ান্ত করা হয়েছে। এতে লাল-সবুজের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ।

এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোরেল কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন সিদ্দিক সংবাদকে বলেন, মেট্রোরেল প্রকল্পের অগ্রগতি ভালো। ইতিমধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের বিভিন্ন পিয়ারের কাজ শেষ হয়েছে। টেস্ট পাইল করার পর মাটির মান পরীক্ষা করতে ৩৮৩টি চেকবোরিংয়ের মধ্যে ৩৬৩টি করা হয়েছে। বাকি ২০টি আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে হয়ে যাবে।

দুই হাজার ৩৭৮টি পাইলের মধ্যে ৭০৪টা শেষ হয়েছে। পাইলের ওপর বসবে পিয়ারক্যাপ। পিয়ারক্যাপের ওপর ৭৩১টি পিয়ার বসবে। পিয়ারের ওপর বসানো হবে ভায়াডাক্ট, যার ওপর দিয়ে মেট্রো ট্রেন চলবে। আগারগাঁওয়ে আমরা পিয়ারক্যাপ বসিয়ে রেখেছি। পিয়ার বসাতে সর্বোচ্চ ১০-১৫ দিন লাগবে। কোচের জন্যও ইতোমধ্যে আদেশ দেয়া হয়েছে। আমরা জাপানে অর্ডার দিয়েছি। সেখানে ট্রেন তৈরির কাজও চলছে। ট্রেনে লাল-সবুজের প্রাধান্য থাকবে।

প্রকল্পের সূত্র জানায়, প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ১৭ শতাংশ। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের উড়ালপথ এবং স্টেশন নির্মাণের কাজ শেষ করার কথা ২০১৯ সালের ৩০ জুনে। আর আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হওয়ার কথা ওই বছরের ডিসেম্বরে। আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশ ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা। এখন পর্যন্ত মেট্রোরেল প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ১০৫ কোটি টাকা। তাই নির্ধারিত সময় প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বহুপ্রতীক্ষিত মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ের চার বছর আগে শেষ হবে। মেট্রোরেলের কাজ প্রথমে শেষ করার কথা ছিল ২০২৪ সালে। সেখানে জাপানিরা কমাতে কমাতে এটাকে ২০২০ সালে নামিয়ে এনেছে। হলি আর্টিজান ঘটনার পরে এই প্রজেক্ট বাস্তবায়ন হবে এটা কেউ বিশ্বাস করেনি। কিন্তু জাপানিরা এগিয়ে এসেছে। এ কারণে ছয় মাস পিছিয়ে গেছে, তারপরও এটাকে জাইকা এগিয়ে নিয়ে এসেছে। এটি চালু হলে প্রতি ঘণ্টায় উত্তরা থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত ৬০ হাজার মানুষ আসা যাওয়া করবে। দিনে পাঁচ লক্ষ।

আরও এরকম পাঁচটি এমআরটি লাইন হবে। এমআরটি লাইন-৫ এর কাজ জানুয়ারি মাস থেকে শুরু হবে। এই ছয়টি লাইনের কাজ শেষ হলে ঢাকা শহরের যানজট নিরসন হবে বলে আমরা আশা করি। বাংলাদেশে প্রথম পাতাল রেল হবে এমআরটি লাইন-১। এরই মধ্যে আমরা এর চুক্তি করে ফেলেছি। কমলাপুর থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত পাতাল রেল হবে। এমআরটি লাইন-১ এর কাজ শেষ হবে ২০২৬ সালে।

অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়, এ বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত এই প্রকল্পের সার্বিক বাস্তব অগ্রগতি সাড়ে ১৬ শতাংশ। আর প্রকল্পের সার্বিক আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ২৩ দশমিক ২২ শতাংশ। ১২০ মিটার উড়ালপথ (ভায়াডাক্ট) দৃশ্যমান হয়েছে। সংশোধিত পরিকল্পনা অনুযায়ী মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। ২০১২ সালে এমআরটি-৬ বা মেট্রোরেল প্রকল্প নেয়া হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় বিশেষ উদ্যোগে সংশোধিত পরিকল্পনা নেয়া হয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, মেয়র হানিফ উড়ালসড়ক ও মৌচাকে উড়ালসড়ক নির্মাণ করতে গিয়ে সবচেয়ে সমস্যা হয়েছিল সেবা সংস্থার লাইন সরাতে। কিন্তু মেট্রোরেল প্রকল্পে সেই সমস্যা নেই। সেবা সংস্থার লাইন আগেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কাজ দ্রুত শেষ করার সব আয়োজন আছে। সরকার ও ঠিকাদার চাইলে কাজ দ্রুত করা সম্ভব। মেট্রোরেলের মতো প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি দেখতে সময় লাগে। শেষের দিকে কাজের গতি অনেক বেড়ে যায়। তবে মেট্রোরেলের কাজ শেষ করার জন্য যে সময় নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি খুবই আঁটসাঁট। মেট্রোরেলের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হওয়া নিয়ে তিনি আশাবাদী হতে পারছেন না বলে জানান।

এই বিভাগের আরও খবর