,

ডায়াবেটিসের নতুন চিকিৎসা

অধ্যাপক ডা. খাজা নাজিম উদ্দিন: খাওয়ার ওষুধ এবং ইনজেকশন দিয়েই মূলত ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করা হয়।

ট্যাবলেট (খাওয়ার ওষুধ) : বেশিরভাগ রোগীই ডায়াবেটিসের চিকিৎসার জন্য সংগত কারণে ট্যাবলেট খায় এবং খেতে চায়। ১৯২১ সালে ইনসুলিন আবিষ্কার হওয়ার অনেক পরে ট্যাবলেটের প্রচলন হয়। বিভিন্ন ধরনের ট্যাবলেট পাওয়া যায়। ডায়াবেটিসের কারণকে লক্ষ্য রেখেই এগুলোর আবিষ্কার হয়েছে এবং উৎপাদন ও সরবরাহে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে এবং হচ্ছে।

সেনসিটাইজার গ্রুপ সংবেদনশীলতা বাড়ায়। এরা হাইপগ্লাইসেমিয়া কম করে।

মেটফরমিন : আদি ড্রাগ এবং পরিবেশনার জন্য মলিকুলের পরিবর্তন ছাড়া এর কোনো শ্রেণীগত পরের জেনারেশন নেই। আমাদের রক্তে গ্লুকোজ দু’ভাবে বাড়ে। ১. খাদ্যদ্রব্য থেকে এবং ২. অভুক্ত অবস্থায় লিভার থেকে। ইনসুলিন দুটোকেই নিয়ন্ত্রণ করে। ডায়াবেটিসে ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা হ্রাস পায় বলে রক্তে গ্লুকোজ বাড়ে। মেটফরমিন ক্ষুধা হ্রাস করে, ওজন ঠিক রাখে, গ্লুকোজ ঠিক রাখে। লিভার থেকে গ্লুকোজ বেরুনো প্রতিরোধ করে, মাংসপেশী ও অন্য জায়গায় গ্লুকোজের ব্যবহার বাড়ায়। মেটফরমিন খরচ, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও যৌথ ব্যবহার বিবেচনায় সবচেয়ে উপযোগী ও গ্রহণযোগ্য। মেটফরমিন অনেকদিন ব্যবহার করলে ভিটামিন বি১২ ও ক্যালসিয়াম কমে তাই প্রতিরোধক হিসেবে এগুলো নিয়মিত ব্যবহার করা উচিত।

গ্লিটাজোন : হার্টের ওপর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়, অস্টিওপরোসিস, মূত্রাশয়ের ক্যান্সার করে বিধায় কম মাত্রায়, স্বল্প দিনের জন্য সীমিত আকারে ব্যবহৃত হয়। গরু, খাসির মতো মানুষের লিভারে চর্বি থাকে। ইনসুলিনের অকার্যকারিতার জন্য ডায়াবেটিসে লিভারের চর্বি সরতে চায় না। এ চর্বি লিভারে দীর্ঘস্থায়ী প্রতিক্রিয়া হিসেবে ফাইব্রোসিস, সিরোসিস ও ক্যানসার করতে পারে। স্বল্পমাত্রার পায়োগ্লিটাজন এ চর্বি কমানোর কার্যকরী ওষুধ।

সিক্রেটগগ : এ গ্রুপের ওষুধগুলো প্যানক্রিয়াস থেকে ইনসুলিনের নিঃসরণ বাড়ায়। প্যানক্রিয়াসের নিঃসরণ ৫০% কমে গেলে ডায়াবেটিস হয় অর্থাৎ যাদের ডায়াবেটিস হয়েছে তাদের প্যানক্রিয়াসের ইনসুলিন ৫০% কমে গেছে। তাই সিক্রেটগগগুলো ক্রমাগত প্যানক্রিয়াসকে স্টিমুলেট করতে থাকলে এক সময় প্যানক্রিয়াস তার নিঃসরণ ক্ষমতা সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলে আর ইনসুলিন নিঃসরণ হয় না এবং ট্যাবলেট অকার্যকর হয়ে পরে একে বলে সেকেন্ডারি ফেইলর। অধিকাংশ সিক্রেটগগ ২৪ ঘণ্টা কাজ করে বিধায় দিনে একবার খেলে হয়। গ্লাইবেনক্লামাইড সবচেয়ে পুরনো, সবচেয়ে সস্তা ও সবচেয়ে ক্ষমতাধর। গ্লিমিপেরাইড বাজারে পরে এসেছে, তুলনামূলক ভাবে দাম বেশি। সবগুলোর বড়দোষ হাইপগ্লাইসেমিয়া করে। মেটিগ্লনাইড, রিপাগ্লিনাইড স্বল্পমেয়াদি। যাদের খাওয়ার ওয়াক্ত নিয়মিত নয়, খাওয়ার বেশ পরে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয় এবং সালফোনিলুরিয়া এলার্জি হয় তাদের জন্য এগুলো ভালো।

ইনক্রেটিন গ্রুপ : জিএলপি-১ এনালগ-(লিরাগ্লুটাই, এক্সিনাটাইড) রক্তে ইনসুলিনের পরিমাণ বাড়ায়। খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যনালি থেকে জিএলপি-১ নামক হরমোন নিঃসৃত হয়। জিএলপি-১ ক. প্যানক্রিয়াস থেকে ইনসুলিনের নিঃসরণ বাড়ায়, খ. পাকস্থলি থেকে বেরুতে দেরি করিয়ে দেয়, গ. প্যানক্রিয়াস থেকে গ্লুকোজ নিঃসরণ কমায় -গ্লুকোজ ইনসুলিনের বিপরীতে কাজ করে অর্থাৎ রক্তে গ্লুকোজ বাড়ায়; সমন্বিতভাবে কাজ করে জিএলপি১ রক্তে গ্লুকোজ কমায়। এছাড়াও নতুনতর এ ওষুধগুলো ব্রেইনের ওপর কাজ করে ক্ষুধা কমায় তাতে সুগার কমে এবং ওজন কমে। প্যানক্রিয়াসের কোষ নষ্ট হওয়া প্রতিরোধ করে ও নতুন কোষ বানায় বলে অনেকে দাবি করে এরা ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করে। ইনজেকশনে দেয়া এ ওষুধগুলো দিনে বা সপ্তাহে একবার দেয়া যায়; ক্ষেত্র ভেদে ওজন কমানোর জন্য এবং ডায়াবেটিস কন্ট্রোলের জন্য এটা কার্যকরী ওষুধ; হার্ট, রক্তনালি ,কিডনির অসুখের রোগীদের জন্য গ্লুকোজ কমানো ছাড়াও এগুলোর বিশেষ কার্যকারিতা আছে। সমস্যা একটাই সেটি হল খরচ বেশি। প্রাথমিক পর্যায়ে খাদ্যনালির ওপর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, শুধু ইনজেকশন (ট্যাবলেট নেই) বিধায় অনেকেই নিতে আপত্তি করে। গলগন্ড রোগ ও লিভারে অসুখ থাকলে এগুলো দেয়া যায় না।

গ্লিপ্টিন (ডিপিপি ৪ ইনহিবিটর) : অপেক্ষাকৃত ব্যয়বহুল এ ওষুধগুলো জিএলপি-১ কে ভাঙতে দেয় না তাই জিএলপি-১ এর মাধ্যমে শরীরে ইনসুলিনের সরবরাহ বাড়ায়। লিনাগ্লিপটিন লিভারের অসুখ থাকলেও দেয়া যায়, সেক্সাগ্লিপটিন হার্ট ফ্রেন্ডলি নয়। কিডনির অসুখ থাকলে বিশেষ করে ক্রিয়াটিনিন ক্লিয়ারেন্স ৩০ এর কম হলে এগুলো ব্যবহার করা যাবে না। এগুলো ওজন বাড়ায় না।

এসজিএল২ ইনহিবিটর, একারবোজ জাতীয় ওষুধগুলোর কার্যকারিতা ইনসুলিন নির্ভর নয়।

এসজিএল২ ইনহিবিটর (গ্লিফ্লাজন) : নতুনতর ওষুধগুলো খুবই কার্যক্ষম এবং ব্যয়বহুল। আমাদের রক্তের গ্লুকোজের একটা নিয়ন্ত্রক হল কিডনি। একটা নির্দিষ্ট মাত্রার বেশি হলে কিডনি আর ধরে রাখে না বের করে দেয়। প্রয়োজনীয়টা ধরে রাখে। এ ধরে রাখার বিরোধিতা করে কাজ করে এ ওষুধগুলো। ডায়াবেটিস রোগীর প্রস্রাব দিয়ে বেশি করে গ্লুকোজ বের করে দেয়। গ্লুকোজ যাওয়ার জন্য এই নালিতে ইনফেকশন হয়। ব্যাক্টেরিয়াল, ফাংগাল সব ধরনের ইনফেকশন হয়। প্রস্রাবের রাস্তার বাইরে চুলকায়। এরা অনেক ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপ কমায়, ওজন কমায়। সবচেয়ে বড় উপকার হার্টের ক্ষেত্রে। হার্টের অসুখের রোগীর পরবর্তী জটিলতা কমায়, মৃত্যুর সংখ্যা কমায়। যাদের হার্টের অসুখ নেই কিন্তু ঝুঁকি আছে তাদের হার্টের অসুখ ঠেকায়। ডিহাইড্রেশন করে বিধায় সুগার স্বাভাবিক থাকলেও কিটোএসিডসিস করতে পারে।

চিকিৎসা কীভাবে শুরু এবং সম্পন্ন : ডায়াগনোসিসের সঙ্গে সঙ্গে কোনো সতর্কতা না থাকলে মেটফরমিন দিয়েই শুরু করতে হবে লাইফ স্টাইল বদলানোর সঙ্গে। তিনমাস এবং সর্বোচ্চ ডোজ (৩০০০ মি.গ্রাম) ব্যবহার করে এ১সি ৭ এর নিচে না এলে আরেকটা ট্যাবলেট যোগ করতে হবে। ওপরে বর্ণিত যে কোনো একটি ওষুধই দ্বিতীয় ওষুধ হিসেবে সংযুক্ত ও সমন্বয় করা যাবে। কার জন্য কোনো ওষুধটা ব্যবহার করা হবে তা ঠিক করা হয় ওষুধের কার্যক্ষমতা, হাইপোগ্লাইসেমিয়া ও অন্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, হার্ট, রক্তনালি, কিডনির ওপর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া, ওজন বাড়ানো বা কমানো, খরচ ও রোগীর পছন্দ বিবেচনায় নিয়ে। খাবার ওষুধ ছাড়া বেসাল ইনসুলিন ও দ্বিতীয় ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। ২০০৮ সালের পর থেকেই হার্ট সেফটি প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত এফডিএ (আমেরিকান ফুড ও ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) ওষুধ বাজারজাতকরণের অনুমতি দেয় না। তাই কারও হার্টের অসুখ থাকলে বা হার্টের অসুখ হওয়ার ঝুঁকি থাকলে নতুনতর ওষুধ যেমন গ্লিফ্লাজন, লিরাগ্লুটাইট মেটফরমিনের সঙ্গে যোগ করা বিজ্ঞানসম্মত।

এ১সি ৯ পর্যন্ত একটা ওষুধ দিয়ে, ৯ এর বেশি হলে দুটি ওষুধ এবং ১০ এবং রক্তের গ্লুকোজ ৩০০ মি.গ্রাম (১৬.৭ মিমোল) এর বেশি হলে ইনসুলিন দিয়ে শুরু করতে হবে। নতুন রোগীর ক্ষেত্রে এটার ব্যতিক্রম হতে পারে। তবে কারো যদি হাইপারগ্লাইসেমিয়ার বিশেষ উপসর্গ যেমন দ্রুত ওজন কমা, ভীষণ তৃষ্ণা বা ক্ষুধা, দুর্বল লাগা, ইনফেকশন থাকলে ইনসুলিন দিয়েই শুরু করতে হবে। যে কোনো অবস্থাতেই প্রয়োজনে ইনসুলিন অতিশীঘ্রই শুরু করতে হবে। দেই, দিচ্ছি, দেখির স্থবিরতা বাদ দিতে হবে। রোগীকে বোঝাতে দেরি করে কিডনি দুর্বল করে ইনসুলিন দেয়ার চেয়ে আগে ইনসুলিন দিয়ে সুগার নিয়ন্ত্রণে এনে পরবর্তিতে ট্যাবলেটে যাওয়াই উত্তম।

লেখক : মেডিসিন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ, বারডেম, ঢাকা

এই বিভাগের আরও খবর