,

চাপকলের পানি নিয়ে ‘আজগুবি প্রচার’

জেলা প্রতিনিধি, চুয়াডাঙ্গা: যেসব রোগ সহজে সারার নয়, সেগুলো একটি বিশেষ চাপকলের পানি পানেই সেরে যাবে এমন কথা ছড়ানোর পর চুয়াডাঙ্গার একটি গ্রামের পায়রা খাতুন নামে একজনের বাড়িতে আসা মানুষের সারি দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।

চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার পোলতাডাঙ্গা গ্রামে বাড়িটিতে প্রতি শুক্র ও সোমবার সেখানে পানি বিতরণ করা হয়। আর প্রচারটা এমন : কেবল এই টিউবওয়েলের পানিতে ভালো হচ্ছে ক্যানসার, ডায়াবেটিস, জন্ডিস, প্যারালাইসিসসহ নানা জটিল ও কঠিন রোগ।

টিউবঅয়েল থেকে এত পানি চেপে বের করা কঠিন, তাই লাগানো হয়েছে বৈদ্যুতিক পাম্প। আর ড্রামগুলো ভর্তি করে দিচ্ছেন পায়রা খাতুনের স্বামী ইকরামুল জোয়ার্দার।

এই পানির গুণাগুণের গল্প ছড়িয়ে দিতে রীতিমতো ৮ থেকে ১০ জন নারীকে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। তারা আবার ভালো হওয়ার কথা বলে যান নতুন আসা মানুষদের। এমন কৌশলে জমজমাট হয়ে ওঠছে পায়রা খাতুনের পানির কারবার।

অসুস্থ হয়ে মাথায় চুলের জট বাঁধা ও জিন ভর করার গল্প শোনালেন মাতা পায়রা খাতুন। তিনি বলেন, ‘বেশ কয়েক বছর আগে অসুস্থ হলে ডাক্তার-কবিরাজ দেখিয়েও সুস্থ হতে পারিনি। সে সময় আমার মাথার চুলে জট বাঁধে। আমার শরীরে জিন ভর করে। স্বপ্নে নিয়মিত দেখায় টিউবওয়েলের পানি মানুষকে দেয়ার জন্য। এতে সব রোগ ভালো হয়ে যাবে, আমিও সুস্থ হয়ে উঠব।’

পায়রার দাবি, সে সময় এক প্রতিবেশী এসে তাকে বলেন, ‘স্বপ্ন দেখলাম তোমার এই টিউবওয়েল পানি খেলে আমার মেয়েদের রোগ ভালো হবে।’ তখন পানি পানে সেই রোগ ভালো হয়েছে এমন দাবি পায়রার।

যদিও যারা পানি নিয়ে যান, তাদের কাছ থেকে উপকার পাওয়ার প্রমাণ আর পাওয়া যায় না।

এক স্বজনের কাছ থেকে শুনে থাইরয়েডের সমস্যা নিয়ে ঢাকা থেকে পানি নিতে চুয়াডাঙ্গার গ্রামে এসেছেন মারিয়া খাতুন। তবে উপকার পাননি। তিনি বলেন, এক সপ্তাহ থেকে পানি খাওয়া শুরু করেছি। এখনও কোনো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি না।’

আলমডাঙ্গা উপজেলার ভাংবাড়িয়া গ্রাম থেকে আসা বেদানা খাতুন বলেন, ‘যতদিন না সারবে ততদিন এই পানি খেতে হবে। এক সময় দেখা যাবে ঠিকই ভালো হয়ে যাবে।’

তিনি জানান, প্রতিবার নানা বিভিন্ন অজুাহাতে নগদ টাকা, চাল, ডালসহ বিভিন্ন জিনিস দাবি করেন পায়রা খাতুন।

কুষ্টিয়ার আঁখি খাতুন, মেহেরপুরের জাহানারা খাতুন, লক্ষ্মীপুর জেলার সকিনা খাতুনও বললেন একই কথা।

টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করে পায়রা বলেন, ‘সপ্তাহে দুইদিন সর্বরোগের মুক্তির জন্য পানি দিয়ে থাকি। এ সময় শিরনী করার জন্য যে যা দেই তাই নিয়ে থাকি।’

পায়রা খাতুনের চাপকলের পানিতে বিশেষ কিছু আছে, এটা বিশ্বাস করছেন না স্থানীয় অনেকেই, যাদের একজন মাসুম আলী। তিনি বলেন, ‘টিউবওয়েলের পানি খেয়ে যদি রোগ ভালো হতো, তাহলে দেশে আর ডাক্তার থাকত না। যারা পায়রা খাতুনের কাছে পানি আনতে যায়, তাদের আমরা নিষেধ করি।’

স্থানীয় ইউপি সদস্য ইসরাইল হোসেন পায়রা বেগমের এই দাবিতে প্রতারণা হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, ‘পানি নিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন আসে। স্থানীয় প্রশাসন প্রতারণার বিষয়টি জেনে যাওয়ায় এখন গোপনে ব্যবসা করছে। আমরা ঊধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়েছি।’

নাগরিক সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক বা সুজন এর চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মাহবুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘বিজ্ঞানের এই যুগে পানি পানে রোগমুক্তির ঘটনা একটি গুজব ছাড়া আর কিছুই নয়। সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে প্রতারণা করে আসছে চক্রটি।’

শুধু পানি পানে রোগ ভালো হওয়ার কোনো ভিত্তি নেই বলে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন সাজ্জাৎ হাসান। তিনি বলেন, ‘পানি পানে শরীরের পানিশূন্যতা দূর হবে, কোনো রোগ ভালো হবে না। এটা সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই না। আমরা পায়রা খাতুনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’

এই বিভাগের আরও খবর