,

কাশিয়ানীতে ‘ডিজিটাল হাজিরা মেশিন’ ক্রয়ে অনিয়ম

লিয়াকত হোসেন লিংকন: প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উপস্থিতি শতভাগ নিশ্চিত করতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে ১৬৯টি বিদ্যালয়ে বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন স্থাপন করা হয়। ৩ কোটি ৭ লাখ টাকা ব্যয়ে এসব মেশিন ক্রয় করা হলেও কাজে আসেনি শিক্ষক-শিক্ষার্থীর।

তিন বছর পরেও অচল হয়ে পড়ে আছে ১৬৯টি বিদ্যালয়েরই বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন। ফলে গচ্ছা গেছে সরকারের কোটি কোটি টাকা। এছাড়াও এসব মেশিন ক্রয় নিয়েও রয়েছে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ।

বিডিনিউজ ১০ ডটকমের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে উপজেলার ১৬৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডিজিটাল হাজিরা মেশিন স্থাপনা করা হয়। এসব মেশিন তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. আব্দুল্লাহ আল বাকী ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আনন্দ কিশোর সাহার নির্দিষ্ট করে দেয়া কোম্পানী থেকে ক্রয় করা হয়। ‘এইচআর অটোমেশন’ নামে একটি কোম্পানী ‘ইনোভয়েস’ ব্র্যান্ডের ডিজিটাল হাজিরা মেশিন সরবরাহ করে। বিদ্যালয়ের ¯িøপ ফান্ড থেকে চেকের মাধ্যমে মেশিন কেনার টাকা কোম্পানীকে পরিশোধ করেন শিক্ষকরা। প্রতিটি মেশিন ২২ হাজার টাকা মূল্যে কেনা হয়। যদিও বাজারে এ মেশিনের দাম ১৪ থেকে ১৬ হাজার টাকা। জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশে নির্ধারিত কোম্পানী থেকে মেশিন কেনায় বাজার যাচাইয়ের সুযোগ পাননি শিক্ষকরা। এভাবে বড় ধরণের দুর্নীতি করে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে একটি সিন্ডিকেট।

অথচ মন্ত্রণালয়ের আদেশে বলা হয়-স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাজার থেকে যাচাই করে সাশ্রয়ী মূল্যে নিজেদের পছন্দমতো ডিজিটাল হাজিরা মেশিন ক্রয় করে স্কুলে স্থাপন করবে। এক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান হতে ডিজিটাল হাজিরা মেশিন ক্রয়ের কোন বাধ্যবাধকতা নেই। এ ব্যাপারে কোন ব্যত্যয় হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

মন্ত্রণালয়ের এ নির্দেশ উপেক্ষা করে কেনা এসব মেশিন কিছুসংখ্যক বিদ্যালয়ে চালু হলেও কয়েকদিনের মধ্যে তা অকেজো হয়ে পড়ে। তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত মেশিনগুলো সচল হয়নি। উপজেলার অর্ধশতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে কোথাও ডিজিটাল হাজিরা মেশিন সচল পাওয়া যায়নি। অনেক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ডিজিটাল হাজিরা মেশিনের ব্যবহার সম্পর্কেও জানেন না।

কাশিয়ানী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. কামরুল হাসান বলেন, ‘তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসটি) আব্দুল্লাহ আল বাকি ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আনন্দ কিশোর সাহা স্যার ‘এইচআর অটোমেশন’ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। তাদের নির্দেশে স্কুল উন্নয়নের ¯িøপ ফান্ড থেকে চেকের মাধ্যমে ২২ হাজার টাকা কোম্পানীকে পরিশোধ করি। কিন্তু এখন পর্যন্ত মেশিনটি চালু হয়নি। অকেজো হয়ে পড়ে আছে।’

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদেরকে ওপর (জেলা পর্যায়) থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমাদের পছন্দমত ও বাজার যাচাই করে হাজিরা মেশিন কেনার কোন সুযোগ ছিল না। এইচআর অটোমেশন কোম্পানীর সরবরাহকৃত ‘ইনোভয়েস’ ব্র্যান্ডের হাজিরা মেশিন কিনতে আমাদের একপ্রকার বাধ্য করা হয়েছে।

কাশিয়ানী উপজেলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. নাসিবুর রহমান বলেন, ‘আমি ১৫টি বিদ্যালয় ঘুরে দেখেছি, যার সবগুলো মেশিন অকেজো। মেশিনগুলো অত্যন্ত নি¤œমানের। তবে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার নির্দেশ মোতাবেক আমরা শিক্ষকরা মেশিন ক্রয় করেছিলাম। আমাদের সেখানে কোন কিছু বলার ছিল না।’

ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এইচআর অটোমেশনের স্বত্ত¡াধিকারী মো. হারুন অর রশিদ বলেন, ‘এখানে কোম্পানীর গাফিলতি ও কোন ধরণের অনিয়ম হয়নি। মেশিনগুলো মানসম্পন্ন। মেশিন স্থাপনের পর ইন্টারনেট সংযোগ লাগে। এ জন্য ৩ হাজার টাকা রিচার্জ, সার্ভার এবং সার্ভিস চার্জ রয়েছে। শিক্ষকরা এ টাকা না দেওয়ায় ডিজিটাল হাজিরা মেশিনগুলো চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।’

কাশিয়ানী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা পরিমল চন্দ্র বালা বলেন, ‘এ বিষয় আমি কিছু বলতে পারবো না। আমি ক্রয় কমিটিতে ছিলাম না। তৎকালীন এডিসি ও ডিপিও স্যারের সমন্বয়ে ক্রয় কমিটি করা হয়। ওই কমিটির মাধ্যমে ডিজিটাল হাজিরা মেশিন ক্রয় করা হয়। এখানে আমার কোন দায়-দায়িত্ব নেই।’

তৎকালীন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আনন্দ কুমার সাহার সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) আব্দুল্লাহ আল বাকির নির্দেশ জেলার পাঁচ উপজেলায় ৫টি কোম্পানী মেশিন সরবরাহ করে। কাশিয়ানীতে এইচআর অটোমেশন কোম্পানী ডিজিটাল হাজিরা মেশিন সরবরাহ করে। কোন কোম্পানীর সাথে আমার সংশ্লিষ্টতা নেই।’

সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. আব্দুল্লাহ আল বাকী বদলী হয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

গোপালগঞ্জ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) একেএম হেদায়েতুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি আমি যোগদানের পূর্বে। তাই ফাইল না দেখে কিছু বলতে পারব না। তবে কোন ধরণের অনিয়ম হলে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর