,

ভূমি অফিসের দুই কর্মকর্তা কাছে ’জিম্মি সেবাগ্রহীতারা’

জেলা প্রতিনিধি, নওগাঁ:  নওগাঁ সদর উপজেলার দুবলহাটি ইউনিয়নের একটি গ্রামের নাম ভরাট্ট নওগাঁ। এই গ্রামের মোজাফফর হোসেন তার জমির খাজনা বাবদ সরকারি ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করেন ৯০০ টাকা। কিন্তু তাকে যে রসিদ দেয়া হয়েছে, তাতে উল্লেখ রয়েছে ২৭২ টাকা।

মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে ইউনিয়ন ভূমি অফিস পরিদর্শন করা হয়। ওই সময় ভূমি অফিস থেকে বের হয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন চকপ্রাসাদ গ্রামের খলিলুর রহমান নামের এক ব্যক্তি। এগিয়ে গিয়ে তার সমস্যা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে একরাশ ক্ষোভ ঝাড়েন তিনি।

খলিলুর রহমান বলেন, ‘সামান্য এক টুকরো জমি কিনেছিলাম। সেটি খারিজ করার জন্য আসছিলাম এখানে। ম্যাডামের (ভূমি কর্মকর্তা) সঙ্গে কথা হলে তিনি সব কাগজপত্র দেখে বলেন, আট হাজার টাকা খরচ পড়বে। পরে সাত হাজার টাকা দিয়ে কাজ করিয়ে নিয়েছি।’

এমন অভিযোগের তালিকাটা বেশ লম্বা। দুবলহাটি ইউনিয়ন ভূমি অফিসের দুই কর্মকর্তা উপসহকারী কর্মকর্তা ফাতেমা খাতুন এবং রাসেল হোসেনের বিরুদ্ধে এমন শত শত অভিযোগ রয়েছে। সেবাপ্রত্যাশীদের অভিযোগ, ওই দুই কর্মকর্তার যোগসাজশেই ভূমি অফিসে এক প্রকার জিম্মি হয়ে পড়েছেন তারা।

সরেজমিনে পরিদর্শন করে ওই দুই কর্মকর্তার লাগামহীন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়।

সেবা দেয়ার নামে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে গলাকাটা ফি। তাতে যে কাজ হবে, সেই নিশ্চয়তাও নেই। ফলে চরম ভোগান্তির মধ্যে রয়েছেন স্থানীয়রা।

অভিযোগের শেষ নেই

গ্রামের বাড়ি সরিসপুরে রীতিমতো ব্যক্তিগত অফিস খুলে বসেছেন দুবলহাটি ইউনিয়নের উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা রাসেল হোসেন। জমি-জমার সমস্যায় থাকা মক্কেল ধরা ও টাকা-পয়সার দর কষাকষি চলে সেখানে। পরে যাতে অফিস থেকে কাজ সেরে (অনেক ক্ষেত্রে তাও হয় না বলে অভিযোগ) আর্থিক লেনদেন করা যায় নির্দ্বিধায়।

স্থানীয়দের অভিযোগ, অতিরিক্ত অর্থ ছাড়া ভূমি অফিস থেকে একটি কাজও হয় না। সামান্য হোল্ডিং অনুমোদন দিতেই বিরাট অঙ্কের অর্থ দাবি করেন রাসেল। শুধু তিনি একা সেই টাকা খান না, ভূমি অফিসের প্রসেস সার্ভেয়ার ছালমা খাতুনের মাধ্যমে কাজ করিয়ে নিতে হয় রাসেলের। তাই সেবাপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে টাকার অঙ্কটাও বাড়িয়ে নেন তিনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভূমি অফিসের এক কর্মচারী বলেন, ‘আমি অন্য জায়গায়ও চাকরি করেছি। কিন্তু এ অফিসের মতো মানুষকে হয়রানি হতে কোথাও দেখিনি। টাকা ছাড়া একটা কাজও করেন না উপসহকারী কর্মকর্তা রাসেল হোসেন। তার এক সহযোগী আছেন প্রসেস সার্ভেয়ার ছালমা খাতুন। তাকে দিয়ে তিনি (রাসেল) সব লেনদেন করান।’

রাসেল হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে শিকারপুর ইউনিয়নের গোয়ালী গ্রামের মো. সাবু বলেন, “আমি গত এক মাস ধরে ঘুরতেছি আমার একটা হোল্ডিং অনুমোদনের জন্য। রাসেলকে এক হাজার টাকাও দিছি, কিন্তু আমার কাজটা করে দিচ্ছে না এখনও। ‘আজ এখানে, কাল সেখানে সরকারি কাজে ব্যস্ত আছি’ বলে ঘুরাচ্ছে শুধু।”

একই ইউনিয়নের চকরামকালি গ্রামের বিজিবি সদস্য হাসান আলী বলেন, ‘চাকরির কারণে আমি বাইরে থাকি। রাসেল আমার গ্রামের ছোট ভাই। তাকে হোল্ডিং করার জন্য কাগজপত্র ও এক হাজার টাকাও দিয়েছি, কিন্তু এখনও কাজটা হয়নি। ফোন করলে বলছে, হবে বা হওয়ার মধ্যে আছে কাজটি। কিন্তু কবে হবে, ঠিক জানি না।’

উপজেলার নার্সি গ্রামের আল আমিন বলেন, ‘রাসেল তো চিটার প্রকৃতির লোক। অনেক আগে আমার ৩ বিঘা জমি খারিজের জন্য ৪৩ হাজার টাকা নিয়েছে সে। তবে খারিজ করে দিতে পারেনি। অথচ টাকাও ফেরত দেয়নি। পাঁচ-দশ হাজার করে ছিঁড়ে ছিঁড়ে টাকা ফেরত দিচ্ছে। এখনও ৯ হাজার টাকা পাবো তার কাছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাকে পুলিশের চাকরি দেবে বলে এর আগে ১৭ লাখ টাকা নেয় রাসেল। চাকরি আমার আজও হয়নি, সেই টাকা থেকেও ২০ হাজার টাকা পাবো।’

ভরাট্ট নওগাঁ গ্রামের মোজাফফর হোসেন বলেন, ‘আমার জমির খাজনার চেক কাটতে আসছিলাম ফাতেমা খাতুনের কাছে। তিনি বলেন- এক হাজার টাকা লাগবে। পরে ৯০০ টাকা দিয়েছি। কিন্তু আমাকে চেক দিছে ২৭২ টাকার। আমারা তো এত বুঝিনা। যা চায় দেয়া লাগে। না হলে কাজ করে দেয় না।’

মাতাসাগর গ্রামের মহির উদ্দীন নামে আরেক ভুক্তভোগী জানান, এখানে টাকা ছাড়া কোনো কাজ হয় না। সামন্য একটা খারিজ করতে আসলে যেখানে সরকারি ফি এক হাজার ১০০ টাকা, সেখানে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা ছাড়া কাজ করে না তারা। এত অনিয়ম ও দুর্নীতি, তবু দেখার কেউ নাই।

যা বলছেন অভিযুক্তরা

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ইউনিয়ন ভূমি অফিসের উপসহকারী ফাতেমা খাতুন বলেন, ‘এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাইনা। আপনার যা করার করতে পারেন। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য নয়। যারা বলছে, তাদের ডেকে নিয়ে আসেন। আমি সামনা সামনি শুনতে চাই কে কী বলছে।’

অভিযোগের বিষয়ে উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা রাসেল হোসেনকে ফোন করা হলে বলেন, ‘এ বিষয়ে ফোনে কোনো কথা বলতে পারব না। আপনি অফিসে আসেন।’ এরপর একাধিকবার কল করা হলেও তিনি আর ফোন রিসিভ করেননি।

অন্য কর্মকর্তাদের বক্তব্য

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে দুবলহাটি ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘অতিরিক্ত টাকা নেয়ার ব্যাপারে আমি জানি না। তবে কেউ অভিযোগ করলে সেটা বিবেচনা করে দেখব।’

তিনি আরও বলেন, ‘মানুষ বেশি টাকা দেয় কেন? না দিলেই তো হয়।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এস এম রবিন শীষ বলেন, ‘ভূমি অফিসে সরকারি ফির বাইরে অতিরিক্ত কোনো টাকা নেয়ার সুযোগ নেই।

‘আমি এখানে নতুন যোগদান করেছি। অভিযোগের বিষয়টি জানি না। তবে আমার কাছে কেউ অভিযোগ নিয়ে আসলে তদন্ত করে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর