,

এখনও গুলির শব্দ কানে বাজে

রাজশাহী অফিস: ঢাকার বনশ্রীতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গিয়ে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে পড়ে যান একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রনি আহমেদ। পেছন থেকে পুলিশ, ওপরে চক্কর দেওয়া হেলিকপ্টার থেকে আশপাশে ছুড়ছে গুলি। ঘটনাস্থলেই নিহত হয় চারজন। গুলিবিদ্ধ হন রনি। বিজিবির ছোড়া গুলি তাঁর বাঁ পায়ের ঊরু ভেদ করে চলে যায়। এখন রাজশাহীর বাঘায় গ্রামের বাড়িতে বিছানায় শুয়ে দিন কাটছে তাঁর।

রনির ভাষ্য, নিজে অন্তত তিন হাজার মানুষকে গুলবিদ্ধ অবস্থায় দেখেছেন। নিজ হাতে সাতজনের লাশ বের করেছেন। তিনি বলেন, ‘ঘুমের মধ্যে এখনও লাফিয়ে উঠি। গুলির শব্দ আমার কানে বাজে।’

রনি সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ১৯ জুলাই দুপুরে তিনি বাসায় ফেরার সময় দেখেন পুলিশ এসে গুলি করতে করতে চলে যাচ্ছে। নিজেকে স্থির রাখতে না পেরে লোকজনকে  বলেন–‘যখন ঘরে ঢুকে মারবে সেই দিন বুঝবেন।’ এরপর এ ব্লক, জি ব্লকসহ আশপাশের লোকজন একত্র করে রাস্তায় ব্যারিকেড দেন। মাগরিবের আজান হবে–সেই মুহূর্তে ড্রোন এসে দেখে যায় কোন কোন ব্লকে লোকজন আছে। তারা রাস্তা ব্লক করে প্রধান সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে যান। ওপরে হেলিকপ্টার চক্কর দিয়ে গুলি ছুড়ছে। পুলিশ-বিজিবি সোসাইটির মধ্যে ঢুকে অ্যাভিনিউ রোডে গুলি করা শুরু করল। নিরাপদ স্থানে যাওয়ার জন্য দূরে গেলেন রনি। সামনে ৪-৫ জন ছিল, গুলি লেগে তারা পড়ে গেলেন। তাদের লাশ নেওয়ার জন্য গুলি করতে করতে ধাওয়া করল পুলিশ।

সেই সময়কার পরিস্থিতি সম্পর্কে রনি বলেন, ‘বিজিবির ছোড়া গুলি আমার বাঁ পায়ের উরু ভেদ করে বের হয়ে গেল। অনেক রক্তপাত হচ্ছিল। ভাবলাম আর বাঁচব না, কলেমা পড়া শুরু করলাম।’
গুলি লাগার পর বনশ্রীর এফ ব্লকের ৩ নম্বর রোডে আশ্রয় নেন রনি। সেখান থেকে জি ব্লকের ৩ নম্বর রোডের একটি বাসায় নেওয়া হয় তাকে। তাৎক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে যান এক চিকিৎসক। পরে তাঁকে একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে দেখেন বহু মানুষ গুলিবিদ্ধ। সিট নেই, মেঝেতে চিকিৎসা চলছে। পরে বনশ্রীর ভাড়া বাসায় চলে যান তিনি। সেখান থেকে গোপনে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু ২৬ জুলাই চিকিৎসক বললেন, ‘এখানে আইসেন না, তুলে নিয়ে যাবে।’

এরপরে ঢাকা থেকে গ্রামে ফিরলেও ভয়ে  বাড়িতে ছিলেন না রনি। পাশের উপজেলায় বোনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে জানতে পারেন পুলিশ খোঁজখবর নিচ্ছে ঢাকা থেকে কারা এলাকায় ফিরেছে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়লে নিজ বাড়িতে ফেরেন রনি। ১০ আগস্ট থেকে বাঘা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

রনি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার চণ্ডিপুর গ্রামের কৃষক এলাহি বক্স ওরফে আফাং মিয়ার দ্বিতীয় সন্তান। এক বোন, দুই ভাইয়ের মধ্যে ছোট তিনি। ২০১৬ সালে ঢাকার ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস থেকে ইলেট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পাস করেন তিনি। পরে ঢাকায় জেড থ্রি করপোরেশনে চাকরিজীবন শুরু করেন। বর্তমানে এনারজিসিল্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডে কর্মরত।

গত ২৬ আগস্ট রনির বাসায় গিয়ে দেখা যায়, তাঁর বাঁ পায়ের উরুতে ব্যান্ডেজ বাঁধা। পায়ের নিচে বালিশ দিয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন। চোখ-মুখে এখনও আতঙ্কের ছাপ। সেদিনের ঘটনা জানতে চাইলে শুরুতে কথা বলতে ভয় পাচ্ছিলেন। পরে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রনি বলেন, আকাশে হেলিকপ্টার চক্কর দিয়ে ওপর থেকে গুলি করছিল। নিচে পুলিশ-বিজিবির সঙ্গে ছাত্রদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলছিল। নির্বিচার গুলি করা দেখে মনের টানেই আন্দোলনে যোগ দেন তিনি।

রনির গুলিবিদ্ধ পায়ে শক্তি নেই। তাঁর মা নিলুফা বেগম বলেন, ‘ওর এখন যে অবস্থা, তাতে দ্রুত কোনো কাজ করতে পারবে না।  ওকে যেভাবে গুলি করেছে, তাতে ওর ফিরে আসার কথা ছিল না, আল্লাহ ওকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।’ বাবা এলাহি বক্স বলেন, দেশে যেন এমন পরিস্থিতি আর দেখতে না হয়।

এই বিভাগের আরও খবর