,

২৯ বছর পর বাবা হত্যার প্রতিশোধ নিলেন আইনজীবী

জেলা প্রতিনিধি, গাজীপুর: চোখের সামনেই বাবাকে যখন হত্যা করা হয়, আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান বাহাদুরের বয়স তখন মাত্র ৬ বছর। সহোদর ও সৎ ভাইদের হাতেই খুন হয়েছিলেন তার বাবা সুলতান উদ্দিন বেপারী।

আইনজীবী হয়ে ২৯ বছর পর এবার বাবা হত্যার প্রতিশোধ নিলেন বাহাদুর। আদালতের কাঠগড়ায় অভিযুক্তদের দাঁড় করিয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করেছেন তিনি।

বাহাদুরের দাদা ধনাই বেপারীর ছিল তিন সংসার। তিন ঘরে ১৭ সন্তানের মধ্যে সুলতান উদ্দিনসহ তার ছেলে ছিল ১৩ জন। বিপুল পৈত্রিক সম্পদের উত্তরাধিকার নিয়েই দ্বন্দ্ব ছিল ভাইদের মধ্যে। এই দ্বন্দ্বে সুলতান উদ্দিন বেপারীর আগে তার আরও দুই ভাই প্রাণ হারান।

আগের দুজনের হত্যার বিচার না হলেও সুলতান উদ্দিন বেপারীকে হত্যার মামলায় সোমবার সাতজনের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে আদালত। এই রায়ে দুজনের আমৃত্যু এবং বাকি পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। আমৃত্যু কারাদণ্ডিতদের মধ্যে একজন সুলতানের সহোদর এবং অন্যজন সৎ ভাই। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডিতদের মধ্যেও সুলতানের সহোদর এক ভাই আছেন।

গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত-২ এর বিচারক বাহাউদ্দিন কাজী আলোচিত এ রায় ঘোষণা করেন।

২৯ বছর আগে সুলতানকে হত্যার অভিযোগে মামলাটি করেছিলেন তার আরেক সহোদর মোতাহার হোসেন। কয়েক বছর আগেই তিনি মারা গেছেন। এ ছাড়া অভিযুক্তদের মধ্যেও বেশ কয়েকজন মারা গেছেন। রায়ের সময় বেঁচে থাকা ৮ অভিযুক্ত কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে একজনকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন বিচারক।

আমৃত্যু কারাদণ্ড পাওয়া দুজন হলেন- ৬৫ বছর বয়সী মাইন উদ্দিন ও ৬০ বছর বয়সী আবুল কাসেম বেপারী। তাদেরকে ১০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়েছে।

এ ছাড়া যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তরা হলেন, সুলতানের অপর ভাই ৫৫ বছর বয়সী আব্দুল মান্নান, ৫০ বছর বয়সী স্থানীয় দুলাল উদ্দিন, বেলতলী এলাকার ৬০ বছর বয়সী মাইন উদ্দিন, একই এলাকার ৬০ বছর বয়সী আজিজুল হক। বেকসুর খালাস পেয়েছেন ৬০ বছর বয়সী স্থানীয় গিয়াস উদ্দিন।

নিহতের ছেলে আইনজীবী বাহাদুর বলেন, ‘জমি-জমা নিয়ে আমার বাবা ও আসামিদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল। ঘটনার ১৫ দিন আগেও আসামিদের কয়েকজন তাকে প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। এ কারণে ১৯৯৩ সালের ৩১ আগস্ট শ্রীপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়। কিন্তু ১৫ দিন পরই বাবাকে হত্যা করা হয়।’

বাহাদুর জানান, ১৯৯৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর রাত ১১টার দিকে তার বাবা সুলতান উদ্দিন নিজ বাড়িতে বসে ভাই মোতাহার হোসেন ও প্রতিবেশী মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পারিবারিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলেন। এ সময় আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে দণ্ডিতরা ওই ঘরে প্রবেশ করেন।

এক পর্যায়ে তারা সবাইকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে সুলতানকে ধরে বুকে ও শরীরের বিভিন্ন অংশে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে এবং গুলি করে ঘটনাস্থলেই হত্যা করেন।

এ ঘটনায় নিহেতর ভাই মোতাহার হোসেন শ্রীপুর থানায় মামলা করলে তদন্ত শেষে ১৯৯৫ সালে ১১ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।

১৯৯৭ সালে গাজীপুর অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে এ মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। দীর্ঘ শুনানী ও ১৪ জনের সাক্ষ্য শেষে সোমবার আসামিদের উপস্থিতিতে মামলার রায় হয়েছে।

বাহাদুর আরও জানান, গত ২৯ বছর মামলা চলাকালীন অভিযুক্ত আরও ৫ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। তারা হলেন- ওই এলাকারই ময়েজ উদ্দিন বেপারী, মোমেন, মোস্তফা, আব্দুল ওয়াহাব ও হানিফা।

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বাহাদুর বলেন, ‘আমার বাবাকে যখন হত্যা করা হয়, তখন আমার বয়স ছিল ৬ বছর। আমার চোখের সামনেই তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। বাবা হত্যার বিচার নিশ্চিত করতে নিজে আইনজীবী হয়েছি। সন্তান হিসাবে পিতা হত্যার রায়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে সহযোগিতা করতে পেরেছি। এটা আমার অনেক বড় পাওয়া। আসামিদের ফাঁসি হলে হয়তো আরও বেশি খুশি হতাম।’

এই বিভাগের আরও খবর