,

হিজাব বিতর্কের নেপথ্যে প্রধান শিক্ষকের দুর্নীতি

জেলা প্রতিনিধি, নওগাঁ: নওগাঁর মহাদেবপুরের দাউল বারবাকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ধরণীকান্ত বর্মণ তার দুর্নীতি আড়াল করতেই আমোদিনী পালকে পরিকল্পিতভাবে ফাঁসিয়েছেন বলে জানা গেছে।

ঘটনা তদন্তে মহাদেবপুর উপজেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। ওই কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কমিটি তদন্তের কাজ শুরু করেছে।

এদিকে ঘটনার পরদিন বৃহস্পতিবার শিক্ষক আমোদিনী পালকে কারণ দর্শানোর একটি নোটিশ দেন প্রধান শিক্ষক ধরণীকান্ত বর্মণ। নোটিশে সাত দিনের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে তাকে।

এর আগে বুধবার (৭ এপ্রিল) বিদ্যালয়টির সমাবেশে নির্ধারিত পোশাক না পরে আসায় ছাত্রদের শরীরচর্চার শিক্ষক বদিউল আলম এবং ছাত্রীদের শাসন করেন সহকারী প্রধান শিক্ষক আমোদিনী পাল।

এ ঘটনায় স্কুলটির শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও এলাকাবাসী জানায়, হিজাবের কারণে কাউকে সেদিন মারা হয়নি। স্কুলের নির্ধারিত পোশাক না পরার কারণে দুই শিক্ষক বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে বেত্রাঘাত করেন। তাদের মধ্যে হিন্দু ছাত্রী ও ছেলে শিক্ষার্থীও ছিল।

‘হিজাব পরার কারণে শাস্তি’র অভিযোগটি কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পায় বৃহস্পতিবার। একই দিন ফেসবুকে ভাইরাল হয় দুই শিক্ষার্থীর বক্তব্য এবং স্কুলে হামলার ভিডিও।

ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী উম্মে সুমাইয়া বলে, আমরা স্কুলড্রেসের সঙ্গে হিজাব পরে ছিলাম। ম্যাডাম এসে বলল, তোমরা হিজাব পরে আসো কেন? আমাদের মাস্ক ধরে টানাটানি করেছিল। মাস্ক খুলে দিল, হিজাব ধরে টানাটানি করেছিল। যারা যারা হিজাব পরেছিল সবাইকে মেরেছে। বলছে যে, তোমরা হাজিগিরি করতে আসছ, ঘরের ভেতর গিয়ে বোরখা পরে থাকো। স্কুলে পর্দা করা যাবে না, মাথায় কাপড় দেয়া যাবে না। শুধু স্কুলড্রেস পরে আসবে। হিজাব পরবে না, এই বলে আমাদের হিজাব ধরে টানাহেঁচড়া করেছে। মোটা কঞ্চি দিয়ে অনেক মেরেছে। যারা হিন্দু ছিল তাদের এক সাইডে নিয়ে আমাদের বলেছে, তোমরা ওদের মতো করে আসবে।

প্রায় একই ধরনের অভিযোগ করে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাদিয়া আফরিন। তাদের অভিভাবকদেরও দাবি, হিজাব পরার কারণে শিক্ষক আমোদিনী পাল মেয়েদের মেরেছেন।

ঘটনার পরদিন বৃহস্পতিবার ওই স্কুলে হামলা হয়। অভিযুক্ত শিক্ষক আমোদিনী পালকে স্কুলে না পেয়ে ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করেন। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

ওই দিন স্কুলড্রেসে না যাওয়ায় আমোদিনী পালের বেত্রাঘাত খেয়েছে প্রমি রাণী পাল নামে এক শিক্ষার্থী।

প্রমি বলে, আমরা কয়েকজন আনড্রেস (স্কুল ড্রেস না পরা) ছিলাম। তাই আমোদিনি ম্যাডাম মেরেছিল। কঞ্চি দিয়ে একটু মারছে। আমি সেদিন এমনিই স্কুলড্রেস পরে যাইনি।

হিজাবের কারণে শাস্তির অভিযোগে প্রমি বলে, এটা কীভাবে আসল আমি তো জানি না। আমি তো হিন্দু, হিজাব করি না, আমিও মার খাইছি। অন্য মেয়েরা যারা মার খেয়েছে তাদের কেউ কেউ মাথায় ওড়না দিয়ে ছিল, ওগুলাও তো হিজাব না। তারাও আনড্রেসে ছিল। ছেলেদের মেরেছিল বদিউল স্যার।

বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সভাপতি পবিত্র পাল অভিযোগ করে বলেন, ধরণীকান্ত বর্মণ প্রধান শিক্ষক থাকাকালীন বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যের লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়াসহ বিদ্যালয়ের টাকা লুটপাট করেন। তিনি কয়েক দিনের মধ্যেই অবসরে যাবেন।

তার ভয়, সরকারি নিয়ম অনুসারে পদাধিকার বলে সহকারী প্রধান শিক্ষক আমোদিনী পাল ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পাবেন। তিনি যদি সব অনিয়ম ফাঁস করে দেন তাহলে তিনি বিপদে পড়বেন। আমোদিনী পালের সাথে অন্যায় সমঝোতা করতে না পেরে হিসাব দিতে গড়িমসি শুরু করেন প্রধান শিক্ষক।

পরে বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকসহ অন্যরা আমোদিনীকে পরিকল্পিতভাবে হিজাব বিতর্কে ফাঁসিয়েছেন। বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শাহাদত হোসেন রতন জানান, ছাত্রদের শরীরচর্চার শিক্ষক বদিউল আলম ও ছাত্রীদের শাসন করেন সহকারী প্রধান শিক্ষক আমোদিনী পাল। সে সময় হিজাবের কোনো কথা হয়নি।

পবিত্র পাল জানান, পূর্ব পরিকল্পিতভাবে প্রধান শিক্ষক যোগসাজশে বুধবার রাতে বিদ্যালয়ের দুই একজন শিক্ষক ও অফিস সহকারী মিলে হাসেমপুর গ্রামে গোপন বৈঠক করেন।

এরপর বৃহস্পতিবার হিজাব বিতর্ক অর্থাৎ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ তোলা হয়। এই অভিযোগে এলাকার কয়েকশ’ লোকজন বিদ্যালয়ে এসে আসবাবপত্র ভাঙচুরও করেন।

তিনি বলেন, প্রধান শিক্ষক তার চাকরির ১২ বছর দায়িত্বকালীন লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে ১০ শিক্ষকসহ অফিস সহকারী নিয়োগ দিয়েছেন। বিদ্যালয়ে কোনো হিসাব বই তিনি রাখেননি।

সহকারী প্রধান শিক্ষক আমোদিনী পাল জানান, প্রধান শিক্ষক ধরণীকান্ত বর্মণ কয়েক দিনের মধ্যেই অবসরে যাবেন। এ জন্যে গত কয়েক দিন থেকে ধরণীকান্তের কাছে ধীরে ধীরে হিসাব বুঝে নেয়ার জন্যে অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু তিনি হিসাব দিতে রাজি হচ্ছিলেন না।

তিনি দাবি করেন বলেন, প্রধান শিক্ষক তার লাখ লাখ টাকার অনিয়ম আড়াল করতেই চক্রান্ত করে তাকে ফাঁসিয়েছেন।

তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করে প্রধান শিক্ষক ধরণীকান্ত বর্মণ বলেন, বিদ্যালয় পরিচালনা আহবায়ক কমিটির পরামর্শে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও অশালীন ব্যক্য প্রয়োগের অভিযোগ তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পরামর্শে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তাৎক্ষণিক অভিযুক্ত সহকারী প্রধান শিক্ষককে শোকজ করা করেছেন।

বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির আহবায়ক মাহাবুব হাসান সুমন জানান, নতুন কমিটি গঠন হয়েছে। এখনো সভা করা সম্ভব হয়নি। সহকারী প্রধান শিক্ষককে নতুন কমিটিকে না বলে শোকজ করতে পারেন কি না, এ বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে তিনি জানান।

সহকারী প্রধান শিক্ষককে শোকজের বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে মহাদেবপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার হাবিবুর রহমান জানান, বিষয়টি নিয়ে প্রাথমিকভাবে তার সন্দেহ রয়েছে। তবে রবিবার ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত করা হবে।

মহাদেবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিজানুর রহমান বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে ওই এলাকায় যান। সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং কয়েকজন ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা ওই এলাকাবাসীকে শান্ত থাকার অনুরোধ করেছি।

এ ঘটনায় এলাকায় উত্তেজনা থাকলেও প্রশাসন তৎপরতায় রয়েছে। তবে সহকারী প্রধান শিক্ষক আমোদিনী পালের বাড়িতে পুলিশ মোতায়ন করা হয়েছে। মহাদেবপুর থানার অফিসার ইনচার্জ আজম উদ্দিন মাহমুদ বলেন, যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে প্রশাসন সজাগ রয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর