সোসাইয়ামুত্তু বলেন, ‘একজন দৈনিক মজুরের চেয়ে অনেক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয় আমার।’
গৃহযুদ্ধের পর বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট সোসাইয়ামুত্তুর জীবনে দ্বিতীয় বড় আঘাত। সোসাইয়ামুত্তু বলেন, ‘এখানকার অনেক বাসিন্দা ভাড়ায় অন্যের জমিতে কাজ করেন। পা না থাকায় আমি পারি না।
‘কাজ করতে চাইলেও কেউ আমাকে নেবে না। আমার পক্ষে অন্য দিনমজুরের মতো কাজ করাও সম্ভব না। এটাই বাস্তবতা। ’
অর্থনৈতিক সংকটের আগে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন সোসাইয়ামুত্তু। তখন সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। বিপত্তি বাধে গত বছরের শেষ দিকে। সাত দশকের মধ্যে সবচেয়ে বাজে অর্থনৈতিক মন্দায় পড়ে শ্রীলঙ্কা। মুদ্রাস্ফীতি আর নিত্যপণ্যের আকাশছোঁয়া দাম… তাকে চিনাবাদাম চাষে যেতে বাধ্য করেছে।
সোসাইয়ামুত্তু বলেন, ‘আমরা না হয় কম খেয়ে কিংবা না খেয়েই দিন কাটাতে পারি। কিন্তু বাচ্চারা! ওদের কীভাবে বোঝাব?’
মিত্র দেশ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে ধার নিয়ে ভালোই চলছিল শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি। করোনা মহামারি এসে পাল্টে দেয় পরিস্থিতি। ধস নামে জাতীয় অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখা পর্যটনশিল্পে। এসবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চরমে পৌঁছায় অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা। উত্তরণের উপায় না পেয়ে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে শ্রীলঙ্কা সরকার।
সোসাইয়ামুত্তুর পরিবার শ্রীলঙ্কার সেই ৬২ লাখ মানুষের মধ্যে আছে, যাদের জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (এফএও) ‘খাদ্য নিরাপত্তাহীন’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। ভারত মহাসাগরীয় দেশটিতে গত মাসে খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি ৯৩ দশমিক ৭ শতাংশ রেকর্ড হয়।
কয়েক মাস ধরে বিদ্যুৎ বিভ্রাট, ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি, রুপির মান কমতে থাকা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ঘাটতির সঙ্গে লড়াই করেছে শ্রীলঙ্কা। ২ কোটি ২০ লাখ জনংখ্যার দ্বীপটিতে খাদ্য, জ্বালানি এবং ওষুধের সংকট প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শ্রীলঙ্কার দ্বিতীয় দরিদ্র জেলা এই মুল্লাইটিভু। এখানের ৫৮ শতাংশ পরিবার দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে। সেভ দ্য চিলড্রেনের জুনের এক জরিপে দেখা গেছে, এ জেলার প্রায় এক-চতুর্থাংশ বাসিন্দা সংকটের কারণে বেকার হয়েছেন।
শ্রীলঙ্কা সংকটের ‘বড় বলি’ হচ্ছেন তামিলরা মুল্লাইটিভুর ৫৮ শতাংশ পরিবার দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে।
দেশজুড়ে চালানো জরিপে ৩১ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক উত্তরদাতা জানিয়েছেন, সুসাইয়ামুত্তুর মতো তারাও সন্তানদের খাবার নিশ্চিত করার জন্য নিজেদের খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছেন।
দাতব্য সংস্থা টিয়ার্স অফ ভ্যান্নির প্রতিষ্ঠাতা সোমা সোমানাথন বলেন, ‘অর্থনৈতিক এই সংকট তাদের (মুল্লাইটিভু জেলার বাসিন্দাদের) খারাপ থেকে আরও খারাপ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। তাদের আসলে সেই মঞ্চে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, যেখানে তারা গৃহযুদ্ধের পর পরই ছিল।’
শ্রীলঙ্কার সামাজিক ক্ষমতায়ন মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারি নিল হাপুহিনে বলেন, ‘এই পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার জন্য কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। ছয় লাখ মানুষকে প্রতি মাসে নগদ অর্থ দেয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে আমাদের। চলতি বছর ৩২ লাখ পরিবারে ১৪৬ বিলিয়ন ডলার বিতরণ করা হবে।
খাদ্য সংকট দূর করতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ঋণ নিয়েছে শ্রীলঙ্কা সরকার। ২০০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে খাবারের সংকট আপাতত মেটানো যাবে বলে মনে করছে দেশটির সরকার। অন্যান্য সংকট মোকাবিলায় বিশ্বব্যাংকের পাশাপাশি জাতিসংঘের বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর কাছে হাত পাতছে শ্রীলঙ্কা সরকার।
সন্ধ্যায় কোদাল ফেলে হাত-মুখ পরিষ্কার করতে করতে সোসাইয়ামুত্তু বলেন, ‘আরও দুই মাস পর ফসল বিক্রির উপযুক্ত হবে।
‘নিত্যপ্যণের দাম কমলে আমাদের এতটা কষ্ট করতে হতো না। ১০ ভাগ ভালো থাকতেই সংগ্রাম করতে হচ্ছে।’