,

লঘুচাপ কাল রূপ নিতে পারে ঘূর্ণিঝড়ে

নিজস্ব প্রতিবেদক: ২০২০ সালের মে মাসে আছড়ে পড়েছিল ঘূর্ণিঝড় আম্পান। গত বছর ধেয়ে এসেছিল ইয়াস। এবারও মে মাস আসতেই ফুঁসেছে সমুদ্র। তৈরি হয়েছে ঘূর্ণিঝড়ের ভ্রুকুটি। আন্দামান ও দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর-সংলগ্ন এলাকায় বাসা বাঁধতে চলেছে এটি। আপাতত দক্ষিণ আন্দামান সাগরের ওপর একটি ঘূর্ণাবর্ত অবস্থান করছে। গতকাল শুক্রবার তৈরি হয়েছে লঘুচাপ, যা ক্রমশ শক্তি বাড়িয়ে আগামীকাল রোববার ফণা তুলতে পারে; যার নাম হবে ‘আসানি’।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক জানিয়েছেন, আন্দামান সাগরে রাতে লঘুচাপ তৈরি হয়েছে। এটি শনিবার রাতে নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে। এটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে রোববার।
এবারের ঘূর্ণিঝড়ের পদধ্বনি উস্কে দিয়েছে বিগত তিন বছরের ভয়াবহ স্মৃতি।

আম্পান, ইয়াস ও ফণীর দগদগে ঘা এখনও শুকায়নি। কতটা শক্তিশালী হবে এবারের ঝড়, তা নিয়ে চলছে আলোচনা। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ঘূর্ণিঝড়টি সৃষ্টি হওয়ার পরই বলা যাবে এর গতি-প্রকৃতি।

কতটা প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে :দক্ষিণ আন্দামান ও দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগরের যে লঘুচাপ তৈরি হয়েছিল, সেটি যে শক্তি বাড়িয়ে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হবে, তা আগেই জানিয়েছিলেন আবহাওয়াবিদরা। গতকাল তারা বলেছেন, ওই নিম্নচাপ আরও জলীয় বাষ্প সংগ্রহ করে শক্তি বাড়িয়ে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে। এই ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে কতটা প্রভাব ফেলবে বা আদৌ প্রভাব ফেলবে কিনা, তা স্পষ্ট জানায়নি আবহাওয়া অধিদপ্তর। যদিও আবহাওয়ার পূর্বাভাসে আগামী কয়েক দিন ভারি বৃষ্টি হতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ড. মো. আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের গতি-প্রকৃতি নিয়ে এখনই কিছু বলা ঠিক হবে না। তারা লঘুচাপের ওপর নজর রাখছেন।

যদিও বেসরকারি একটি সূত্র দাবি করেছে, আগামী ১৩ মে নাগাদ বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আছড়ে পড়তে পারে।

আমেরিকার নৌবাহিনী পরিচালিত জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টার থেকে প্রাপ্ত তথ্যের বরাত দিয়ে কানাডার সাসকাচুয়ান ইউনিভার্সিটির আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক বাংলাদেশি পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ সমকালকে বলেন, গতকাল সকালে দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে (আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের দক্ষিণ-পশ্চিমে) একটি নিম্নচাপ ও নিম্নচাপ কেন্দ্রে বাতাসের সুস্পষ্ট ঘূর্ণন সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে নিম্নচাপটি আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের পোর্ট ব্লেয়ার থেকে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছে। সেখানে সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা ৩০ থেকে ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির জন্য সমুদ্রের পানির সর্বনিম্ন তাপমাত্রা দরকার ২৬ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। একই স্থানে উল্লম্ব বায়ু শিয়ায় এর মান ৫ থেকে ১৫ নটিক্যাল মাইল, যা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির জন্য খুবই আদর্শ অবস্থা নির্দেশ করে। তিনি জানান, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় এই নিম্নচাপটি উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রবল সম্ভাবনার কথা নির্দেশ করছে আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেলগুলো। আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এ নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সঞ্চয় করে ও বাতাসের গতি বৃদ্ধি পেয়ে ঘূর্ণিঝড়ের প্রাথমিক পর্যায় ডিপ্রেশন ও ডিপ-ডিপ্রেশনে পরিণত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। নিম্নচাপ কেন্দ্রে বর্তমানে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার। বায়ুর গতিবেগ ঘণ্টায় ৬৪ কিলোমিটারের বেশি উঠলে নিম্নচাপটিকে ঘূর্ণিঝড় ‘আসানি’ নামকরণ করা হবে। তবে আগামী ২৪ ঘণ্টার আগে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না, ঘূর্ণিঝড়টি কোন স্থানের ওপর দিয়ে স্থলভাগে আঘাত করবে।

মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ের বিপদ নতুন নয় :এবারের মে মাসেই প্রথমবারের মতো ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তা নয়। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত এক যুগে ঘূর্ণিঝড়গুলোর বেশিরভাগই আঘাত হেনেছে মে মাসে। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, মে মাসের ঘূর্ণিঝড়গুলো মূলত দেশের খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট উপকূলে আঘাত হানে। আর নভেম্বরের ঝড়গুলো চট্টগ্রাম-নোয়াখালী উপকূলের দিকে বেশি যায়। ওই উপকূলের বড় অংশজুড়ে পাহাড় ও দ্বীপ আছে। আর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল উপকূল অপেক্ষাকৃত ঢালু বা নিচু। ফলে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের প্রভাবে সেখানে ক্ষতি হয় বেশি।

আবহাওয়া অধিদপ্তরে সংরক্ষিত ১৯৬০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশে আঘাত হানা ঐতিহাসিক ঘূর্ণিঝড়ের তালিকা ও পরের তিন বছরের ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, এই সময়ে মোট ৩৬টি ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে, যার মধ্যে ১৫টি এসেছে মে মাসে। আর গত এক যুগের (২০০৮-২০২২) তথ্য বিশ্নেষণে দেখা যায়, এই সময়ে মোট ১৩টি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে ১০টিই হয়েছে মে মাসে।

মে মাসের পরই রয়েছে নভেম্বর মাস। এই মাসে ১৯৬০ সাল থেকে এ বছর পর্যন্ত ১০টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। একই সময়ে ডিসেম্বর মাসে তিনটি, এপ্রিল, জুলাই ও সেপ্টেম্বর মাসে একটি করে ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের মাটিতে আছড়ে পড়েছে। ২০০৭ সালের নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় সিডর এবং ২০০৯ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় আইলা আঘাত হানে।

সংশ্নিষ্টরা জানান, বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয় নভেম্বর ও এপ্রিল মাসকে। এ জন্য নভেম্বর মাসকে ঘিরে বিশেষ প্রস্তুতি রাখা হয়। এ ছাড়া গুরুত্ব পায় এপ্রিল মাস। বাংলাদেশে জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবসটি মার্চ মাসে। অক্টোবর মাসে পালন করা হয় দুর্যোগ প্রশমন দিবস। কিন্তু এখন মে মাস নিয়ে বিশেষভাবে ভাবার সময় এসেছে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঘূর্ণিঝড়ের বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেন, যে কোনো সময়ে ঘূর্ণিঝড় এলেই আমাদের আগাম প্রস্তুতি থাকে। ফলে গত কয়েক বছরে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কমে এসেছে। এবারও সতর্ক সংকেত দেওয়ার মতো পরিস্থিতি হলে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করে নির্দেশনাগুলো মাঠপর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া হবে। এরই মধ্যে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) স্বেচ্ছাসেবীরা কাজ শুরু করেছেন।

এই বিভাগের আরও খবর