জেলা প্রতিনিধি, বগুড়া: ইটভাটার চুল্লিতে পুড়ছে কৃষিজমি। বছর চারেক আগেই যেখানে ছিল ধানক্ষেত কিংবা সবজি বাগান, সেখানে এখন জলাশয়। সেসব জমির মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে ইটভাটায়। ফলে দিন দিন কমে যাচ্ছে কৃষিজমি। ‘মাটিদস্যুদের’ ভয়ে অসহায় গ্রামবাসী হচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত। এমনকি কৃষক নিজেই মাটিদস্যুদের হাতে জমি তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। আর বসে বসে তা শুধু দেখেই যাচ্ছে উপজেলা প্রশাসন।
এমন ঘটনা বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার। ওই উপজেলার খলিসাকান্দি মধ্যপাড়া গ্রামে কৃষিজমির মাটি দিয়ে ইট প্রস্তুত করা হচ্ছে। গ্রামবাসীর অনেক অভিযোগেও বন্ধ হয়নি মাটি তোলা। ফলে উপজেলা প্রশাসেনর ওপর আস্থা হারিয়ে নীরবে চোখের পানি ফেলছেন কৃষকরা।
স্থানীয়রা বলছেন, ২০১৯ সালে খলিসাকান্দি মধ্যপাড়া গ্রামে ৪৪ শতক কৃষিজমি থেকে প্রথম মাটি উত্তোলন শুরু করে মাটিদস্যুরা। ২০২২ সালে এসে জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬০ বিঘারও বেশি। মাটি উত্তোলনের ওই পয়েন্টের দিকে তাকালে তাদের চোখ জলে ভিজে যায়। সন্ত্রাসী বাহিনীর উপস্থিতিতে রাত থেকে ভোর পর্যন্ত মাটি উত্তোলন করা হয় ওই গ্রামে। পরে সেই মাটি ট্রাকে করে পাঠানো হয় ইটভাটায়।
অভিযোগ রয়েছে, ওই গ্রামে বছর চারেক ধরে মাটি উত্তোলন করছেন শাজাহানপুর উপজেলার মাঝিড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান। নুরুজ্জামান উপজেলার চিহ্নিত ‘সন্ত্রাসী’। তাকে দেখে সবাই আতঙ্কে থাকেন। তার সন্ত্রাসী বাহিনীর ভয়ে মাটি উত্তোলনের ঘটনায় কেউ অভিযোগ করেন না। এছাড়াও অভিযোগ করেও কোনো লাভ নেই। এসিল্যান্ড বা ইউএনও দুই একবার ঘটনাস্থলে আসবেন, এরপরে চলে যাবেন। কিন্তু অবৈধ মাটি উত্তোলন বন্ধ হবে না। দিন দিন তারা উপজেলা প্রশাসনের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। বর্তমানে কৃষিজমির ধ্বংস দেখা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই।
রোববার মধ্যরাতে খলিসাকান্দি মধ্যপাড়া গ্রামের মাটির ওই পয়েন্টে অভিযানে যান এসিল্যান্ড (সহকারী কমিশনার-ভূমি) শানজিদা মুস্তারী।
সোমবার বিকেলে এসিল্যান্ড বলেন, আমি রোববার রাতে খলিসাকান্দি মধ্যপাড়া গ্রামে অভিযানে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওই সময় সেখানে কোনো ট্রাক বা অ্যাসকেভেটর পাইনি। তবে আমি চলে আসার পর হয়ত মাটি উত্তোলন শুরু করে সংশ্লিষ্টরা।
তবে স্থানীয়রা বলছেন, এসিল্যান্ড যখন অভিযানে যান তখন সেখানে তিনটি অ্যাসকেভেটরসহ মাটি বহনের কাজে ব্যবহৃত ৩০-৩৫টি ট্রাকও ছিল। তারা ভেবেছিলেন এবার বুঝি কিছু একটা হবে। কিন্তু ফের তাদের বিশ্বাস ভঙ্গ হয়। এসিল্যান্ড সেখানে আধাঘণ্টা সময় অবস্থান করার পর চলে যান। এরপরেই আবারো শুরু হয় মাটি উত্তোলন।
ওই গ্রামের একজন বাসিন্দা মুঠোফোনে বলেন, চিহ্নিত সন্ত্রাসী নুরুজ্জামানের লোকজন অবৈধভাবে মাটি উত্তোলন করছেন। ভয়ে গ্রামের কেউ প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করছেন না। মাটিদস্যুদের কবল থেকে কৃষিজমি রক্ষা করতে উপজেলা প্রশাসনও এগিয়ে আসছে না। এখন আমরা নীরবে কৃষিজমির ধ্বংস দেখছি।
তিনি আরো বলেন, মাটির ওই পয়েন্টের আশপাশের কৃষকরা তাদের জমি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। কারণ ৩০-৪০ ফুট গভীর করে মাটি উত্তোলনের ফলে আশেপাশের জমিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়াও জমি না কিনে নিয়েও অন্যের জমি থেকে মাটি উত্তোলন করা হয়। ফলে পরবর্তীতে জমি বিক্রি করতে বাধ্য হন কৃষকরা। তবে এ বিষয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা প্রকাশ্যে কিছু বলবেন না। কারণ মাটিদস্যুরা তাদের হত্যাও করতে পারেন।
মাটি উত্তোলনের বিষয়ে ইউপি চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান বলেছিলেন, আমি মাটি উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত নই। আমার একটি ইটভাটা রয়েছে। মাটি ব্যবসায়ীরাই খলিসাকান্দি মধ্যপাড়া গ্রাম থেকে মাটি উত্তোলন করে বিভিন্ন ইটভাটায় সরবরাহ করছেন।
ওই গ্রামের বাসিন্দা সোহরাব হোসেন শ্যামল বলেন, মাস দুয়েক আগে খলিসাকান্দি মধ্যপাড়া গ্রামে নতুন করে মাটি উত্তোলন শুরু করেন নুরুজ্জামান। এতে আশেপাশের কৃষিজমিগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়াও জমি বিক্রি করতে কৃষকদের বাধ্য করা হচ্ছে। মাটি তোলা বন্ধে উপজেলা প্রশাসনের তেমন কোনো ভূমিকা নেই। উপজেলা প্রশাসন অভিযানে গিয়ে কোনো লাভ হয় না। ইউএনও অথবা এসিল্যান্ড ঘটনাস্থল ত্যাগ করার পরই আবারো মাটি উত্তোলন শুরু করে মাটিদস্যুরা।
জানতে চাইলে শাজাহানপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাইদা খানম মুঠোফোনে বলেন, অবৈধভাবে মাটি উত্তোলন বন্ধে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। রোববার রাতে এসিল্যান্ড খলিসাকান্দি মধ্যপাড়া গ্রামে অভিযানে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে কাউকে পাননি তিনি। এছাড়াও সেখানে অ্যাসকেভেটর ও ট্রাকও ছিল না। এসব থাকলে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হতো। কৃষিজমি থেকে মাটি উত্তোলন বন্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।