মাদারীপুর: করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। স্থবির হয়ে আছে সংক্রমিত এলাকাগুলো। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও ওষুধের দোকান খোলা থাকলেও বন্ধ রয়েছে প্রায় সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। উপার্জনের পথ বন্ধ অধিকাংশ মানুষেরই। জমানো টাকা খরচ করে খাচ্ছেন পরিবারগুলো। প্রতিদিন অর্থ খরচ হচ্ছে কিন্তু উপার্জন নেই। খেটে খাওয়া মানুষেরা ত্রাণসামগ্রী পেলেও গ্রামের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর পক্ষে দাঁড়িয়ে থেকে বা ঘুরে ঘুরে ত্রাণ সংগ্রহ করা অসম্ভব। ফলে যতদিন যাচ্ছে তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ তত গভীর হচ্ছে!
জানা গেছে, করোনা ভাইরাসের কারণে দেশের প্রথম লকডাউন করা এলাকা মাদারীপুর জেলার শিবচরে গত ২০ মার্চ থেকেই চলছে কার্যত লকডাউন। মাদারীপুর জেলার করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের একটা বড় অংশই শিবচরের। এক ইতালি প্রবাসীর বাড়ি আসার মধ্যদিয়েই শিবচরে বিস্তার ঘটতে থাকে এ ভাইরাসের। সংক্রমণ ঠেকাতে গত ২০ মার্চ থেকেই প্রশাসনের কঠোর নজরদারিতে রয়েছে উপজেলাটি। বর্তমানে পুরোপুরি লকডাউনে রয়েছে উপজেলাটি। এ উপজেলার সঙ্গে জেলা সদর ও অন্যান্য জায়গার যোগাযোগও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর পর জেলার রাজৈর ও কালকিনি উপজেলাও সম্প্রতি লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। এসব এলাকায় সব প্রকার যানবাহন চলাচল সীমিত রয়েছে। নিত্যপণ্যের দোকান দুপুর ১২টা পর্যন্ত খোলা থাকছে। এরপর শুধু ওষুধের দোকান ছাড়া সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার নির্দেশ রয়েছে। আর সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত শুধু নিত্যপণ্যের দোকানই খোলা থাকবে। এছাড়া অন্য সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে মাদারীপুর জেলার এ সব এলাকার মধ্যবিত্ত মানুষের দুর্ভোগ দিন দিন বেড়েই চলছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। করোনা ভাইরাসের আতঙ্কের সঙ্গে আর্থিক ক্ষতির চিন্তায় রয়েছেন তাদের অধিকাংশ।
বুধবার (১৫ এপ্রিল) মধ্যবিত্ত বেশ কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে আলাপে এমন তথ্যই উঠে আসে। মধ্যবিত্ত এসব পরিবারের মধ্যে তৈরি পোশাকের দোকানি, পুস্তক ব্যবসায়ী, কনফেকশনানি দোকানি, দুগ্ধজাত খামার, শিক্ষকসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষেরা আগামীর জীবন নিয়ে বেশ চিন্তিত রয়েছেন বলে জানা গেছে।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক শিবচরের ক্ষুদ্র এক দুগ্ধজাত খামারের মালিক জানান, বেশ ভালোই চলছিল তার খামার। গরু মোটাতাজাকরণের পাশাপাশি দুগ্ধজাত গরুও রয়েছে তার খামারে। তিন বছরে আসা খামারটিতে কেবল লাভের মুখ দেখা শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে দুগ্ধ বিক্রি করতে পারছেন না। আগে বিভিন্ন মিষ্টির দোকানের সঙ্গে চুক্তি ছিল। তারা প্রতিদিন এসে দুধ নিয়ে যেতো। ১৫ থেকে ২০ কেজি দুধ প্রতিদিন বিক্রি করতেন তিনি। কিন্তু এখন সব বন্ধ রয়েছে। নামমাত্র মূল্যে গ্রামের সাধারণ ভোক্তাদের কাছে দুধ বিক্রি করতে হচ্ছে তাকে। ফলে দুধ বিক্রির টাকায় গরুর খাবারই ঠিকমত হচ্ছে না। ফলে ঘরে জমানো টাকা খরচ করেই খেতে হচ্ছে এখন।’
এক কনফেকশনানি দোকানের মালিক বলেন, ‘করোনা ভাইরাসের কারণে গত প্রায় এক মাস ধরে আমার দোকান বন্ধ রয়েছে। দোকানের আয়ের ওপর বেশ ভালোই চলছিলো আমার সংসার। ব্যাংকে জমানো তেমন কোন টাকা নেই। তবে দোকানের আয়ের ওপর ভালো ছিলাম। কিন্তু এখন ঘরে বসে থাকতে হচ্ছে। অসহায়-দরিদ্র মানুষকে বিভিন্ন সময় নিজেই সহযোগিতা করেছি। কিন্তু এখনতো নিজেই বিপদে পরে গেছি। আয়রোজগার বন্ধ। কিন্তু মুখতো বন্ধ না! একটা চাপা যন্ত্রণা অনুভব করছি প্রতিনিয়ত।’
স্থানীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক বলেন, ‘একটু ভালো থাকার জন্যে দু’একটা টিউশনি করতাম। বেতনের টাকায় এতো বড় সংসারে বেশ টানাটানি করেই চলতে হয়। কোনো সঞ্চয় করা যায় না। বর্তমানে সব বন্ধ। বাড়তি রোজগার নেই। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী দিনগুলোতে সত্যিকার অর্থেই বিপদে পরে যেতে হবে। খেটে খাওয়া মানুষেরা সহজেই খাদ্য সহযোগিতা পেয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের মতো অসংখ্য মানুষের কষ্টটা বাইরে থেকে বোঝা যাবে না। আর লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণ নেওয়ার মতো পরিস্থিতিও তো আমাদের নেই।’
সমাজের এ শ্রেণিটা অর্থাৎ মধ্যবিত্ত মানুষের প্রত্যাশা খুব বেশি নয়। শুধু সম্মানের সঙ্গে একটু খেয়ে-পড়ে বাঁচাটাই এদের জীবন। সমাজের এ পরিবারগুলো সাধারণ একটা শ্রেণির কাছে অনুসরণীয়। যাদের সম্মানের চোখেই দেখে সমাজ। কিন্তু বর্তমানের এ পরিস্থিতিতে চরম বিপাকে পড়েছে এ পরিবারগুলো। করোনা পরিস্থিতিতে অসংখ্য খেটে খাওয়া, দিনমজুর, দরিদ্র মানুষেরা ত্রাণসামগ্রী পাচ্ছেন। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে এ খাদ্যসামগ্রী পেয়ে তারা কিছুটা দিন অন্তত নিশ্চিন্তবোধ করলেও সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণির কপালে জেগে উঠেছে চিন্তার গভীর ভাঁজ। কবে নিয়ন্ত্রণে আসবে করোনা পরিস্থিতি? আদৌ তাড়াতাড়ি আসবে কিনা নিয়ন্ত্রণ। নাকি দীর্ঘমেয়াদী এ সঙ্কট বিরাজ করবে। তাতে করে আগামী দিনগুলো পরিবার-পরিজন নিয়ে ঠিক মতো খেয়ে-পরে টিকে থাকতে পারবেন তো তারা? এ প্রশ্নেই এখন মধ্যবিত্ত অসংখ্য পরিবারের মনে।