,

বিলুপ্তির পথে সাতক্ষীরার মাদুর শিল্প

জেলা প্রতিনিধি, সাতক্ষীরা: দুই দশক আগেও সাতক্ষীরার আশাশুনির তেঁতুলিয়া গ্রামের ৯০ শতাংশ পরিবারের জীবিকা নির্বাহ হতো হাতে তৈরি মাদুর বিক্রি করে। এখন গ্রামটিতে এ কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে হাতেগোনা কয়েকটি পরিবার।

দুই দশক আগেও সাতক্ষীরার আশাশুনির তেঁতুলিয়া গ্রামের ৯০ শতাংশ পরিবারের জীবিকা নির্বাহ হতো হাতে তৈরি মাদুর বিক্রি করে। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, এখন গ্রামটিতে এ কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি পরিবার। যারা এখনো মাদুর তৈরি করছেন, কাঁচামাল সংকট এবং বাজারে কাক্ষিত দাম না পাওয়ায় তারাও এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। খাত সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে জেলার ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্পটি অচিরেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

আশাশুনি ছিল মাদুরের জন্য বিখ্যাত। ওই উপজেলার কাঁদাকাটি, বড়দল, খাজরা ও প্রতাপনগর এলাকায় মাদুর তৈরি করতো কারিগররা। কাঁদাকাটি ও বড়দল এলাকায় মাদুর তৈরি হতো সবচেয়ে বেশি। তবে বর্তমানে হাতেগোনা কয়েকজন এ পেশার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। বাকিরা বেছে নিয়েছেন ভিন্ন পেশা।

বড়দল এলাকায় এক সময়ের মাদুর তৈরির কারিগর গোবিন্দ মণ্ডল। তবে এখন ইটভাটায় শ্রমিকের কাজ করেন তিনি। লাভ না হওয়া ও চাদিহা কম হওয়ার কারণে তিনি ছেড়ে দিয়েছেন এ পেশা।

গোবিন্দ মণ্ডল জানান, মাদুর তৈরির মূল উপকরণ ‘মেলে ঘাস’। দেড় দশক আগেও এ অঞ্চলে প্রচুর কৃষক মেলে ঘাস চাষ করতো। তবে চাহিদা কম হওয়ার কারণে মেলে ঘাসের চাষও কমে গেছে। একটি মাদুর তৈরি করতে সাড়ে চারশ’ থেকে পাঁচশ’ টাকা খরচ হয়। বিক্রি হয় ছয়শ’ টাকায়। লাভ কম হওয়া ও বাজারে হাতে তৈরি মাদুরের চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে তার মতো অনেকেই মাদুর তৈরি ছেড়ে দিয়ে ভিন্ন পেশা বেছে নিয়েছেন।

অধিকাংশ কারিগররা যখন মাদুর তৈরি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন তখন আশাশুনি উপজেলার কাঁদাকাটি গ্রামে নিশিকান্ত অধিকারী ও তার স্ত্রী মালতি অধিকারী আজও মাদুরের মধ্যেই জীবিকার সন্ধান খুঁজে চলেছেন।

নিশিকান্ত অধিকারী জানান, পৈত্রিক ব্যবসা হিসেবেই আমি এখনো মাদুর তৈরি করে হাটে বাজারে বিক্রি করি। তবে এখন আর আগের মতো লাভ হয় না। একটা ছোট আকারের মাদুর তৈরি করতে খরচ হয় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। বিক্রি হয় ৩৫০ টাকায়। বড় সাইজের মাদুর তৈরি করতে খরচ পড়ে যায় ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা। বিক্রি হয় ৬০০ টাকায়। লাভ খুবই সীমিত। এছাড়া মাদুর তৈরির প্রধান উপকরণ ‘মেলে ঘাস’ পাওয়া কষ্টসাধ্য। চাহিদা কম থাকায় চাষিরা এখন মেলে ঘাসের চাষ করতে চায় না। বর্তমানে আমার আশপাশে ৩৫টি পরিবার এখনো মাদুর তৈরির কাজে নিয়োজিত রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আমার স্ত্রী মালতী অধিকারী আমার সঙ্গে মাদুর তৈরিতে সহযোগিতা করেন। যার কারণে আমার বাড়তি শ্রমিক নিতে হয় না। সেক্ষেত্রে আমার খরচ কিছুটা কম হয়। আগে ৭০ থেকে ৮০ জোড়া মাদুর সপ্তাহে তৈরি করলেও বর্তমানে ৩০ থেকে ৪০ জোড়া মাদুর তৈরি করছি। বাজারে মাদুরের চাহিদা কম।

আশাশুনি উপজেলার বড়দল ও বুধহাটা বাজার মাদুর হাটের জন্য বিখ্যাত। প্রতি রোববার বড়দলে, শুক্রবার ও সোমবার বুধহাটা বাজারে বসে মাদুরের হাট। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে মাদুর কারিগরা প্রতি সপ্তাহে তাদের তৈরি করা মাদুর হাটে এনে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করেন। এরপর সেখান থেকে মাদুর চলে যায় খুলনা, যশোরসহ আশেপাশের বিভিন্ন এলাকায়।

মাদুর শিল্পের বিলুপ্তির কারণ হিসেবে আশাশুনির বড়দল গ্রামের মাদুর কারিগর সুব্রত মণ্ডল জানান, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা নেই, প্রধান উপকরণ মেলে ঘাসের অভাব, বাজারে চাহিদা কম মূলত এসব কারণেই এখন মাদুর তৈরি করা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় গেছেন অনেক কারিগর। যারা এখনো তৈরি করছেন তারা মূলত পৈত্রিক ব্যবসা ছাড়তে না পেরে এখনো এ ব্যবসায় পড়ে আছেন।

সাতক্ষীরা শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি নাসিম ফারুক খান মিঠু বলেন, এক সময় সাতক্ষীরা ঐতিহ্য ছিল মেলে মাদুর। এখান থেকে তা সারা দেশে সরবরাহ করা হতো। আশঙ্কাজনকভাবে মাদুর তৈরির কারিগর কমে যাওয়ায় শিল্পটি চরম সংকটে পড়েছে। শিল্পটি বাঁচাতে হলে বর্তমানে যারা এ পেশায় রয়েছেন তাদের সহজ শর্তে ঋণদান ও প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় এক দশক পর এ এলাকায় আর মাদুর তৈরির কারিগর খুঁজে পাওয়া যাবে না।

সাতক্ষীরা বিসিক শিল্প নগরীর কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) আনোয়ার উল্লাহ্ বলেন, বর্তমানে মাদুর খুব একটা দেখা যায় না। আধুনিকতার ছোয়ায় মাদুর শিল্পটিও বিলুপ্তি হতে চলেছে। মাদুর তৈরির মূল কাঁচামাল ‘মেলে ঘাস’ এখন আর খুববেশি পাওয়া যায় না। এছাড়া বাজারে প্লাস্টিকের মাদুরের চাহিদা বেশি, দামও কম। ফলে কারিগররা এ শিল্প থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন।

তিনি বলেন, মাদুর কারিগরদের নিয়ে আমাদের কোনো জরিপ নেই। তবে পূর্বে জেলার আশাশুনি উপজেলায় ২৫০-৩০০টি পরিবার ছিল মাদুর তৈরির উপর নির্ভরশীল। বর্তমানে সেটি কমে দাঁড়িয়েছে ১০০টিতে।

মাদুর শিল্পটি রক্ষায় কোনো উদ্যোগ বা কারিগরদের পৃষ্ঠপোষকতা করা হয় কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, মাদুর কারিগরদের ব্যাপারে বিসিক শিল্প নগরী সাতক্ষীরার পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কোনো কারিগর কখনো সহযোগিতা চেয়ে আমাদের কাছে আসেননি। তবে কেউ যদি সরকারিভাবে ঋণ সহয়তা চায় তাহলে যাচাই-বাছাই করে সহযোগিতা করা হবে।

এই বিভাগের আরও খবর