,

পাউবোর প্রকল্পে ‘পুকুরচুরি’

জেলা প্রতিনিধি, কক্সবাজার: চট্টগ্রামের পটিয়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মেগাপ্রকল্পে সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অধিগ্রহণ করার নামে জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ না দিয়ে প্রভাব বিস্তার করে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করাসহ শতকোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। এ যেন উন্নয়ন প্রকল্পের নামে সীমাহীন ‘পুকুরচুরি’।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২১ সালের ৪ মে একনেক সভায় অনুমোদিত পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে ‘চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নিষ্কাশন ও সেচ প্রকল্প’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ১১৫৮ কোটি টাকা, ‘শ্রীমাই খালে মালটিপারপাস হাইড্রোলিক এলিভেটর ড্যাম নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ১৩৩ কোটি টাকাসহ প্রায় ১৩০০ কোটি টাকার কাজ চলমান রয়েছে।

উপজেলার কুসুমপুরা, ধলঘাট, হাবিলাস দ্বীপ, ভাটিখাইন, আশিয়া, জিরি, কাশিয়াইশ, বড়লিয়া, জঙ্গলখাইন, পৌর এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণে কয়েক শ একর কৃষিজমি নষ্ট করা হয়েছে। স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালীকে নির্মাণসামগ্রী সরবরাহের কাজ দেওয়া হয়, যাতে কেউ প্রতিবাদ করতে না পারে।

এ ছাড়া ১:২.৫:৫ মাত্রার ঢালাই টেন্ডারে থাকলেও বালি ও পাথরের পরিমাণ বেশি এবং সিমেন্টের পরিমাণ কম দেওয়া হচ্ছে। তা ছাড়া ঢালাইয়ের পর কমপক্ষে ২১ দিন ব্লক ভিজিয়ে রাখতে হয়। রোদ বেশি হলে এর সময়কাল আরো বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা মানা হচ্ছে না। শিডিউলে বালির এফএম কমপক্ষে ১.৫ হলেও ব্যবহার হচ্ছে এফএম ১ থেকে .৮ সাইজের কাদাযুক্ত বালি।

সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, হাইদগাঁও রাজঘাটা ব্রিজের পাশে ৪-৫টি স্পটে ইঞ্জিনিয়ারের অনুপস্থিতিতে দেদার চলছে নিম্নমানের বালি, সিমেন্ট, এলসি পাথরের সাথে লোকাল পাথর মিশিয়ে ব্লক ঢালাইয়ের কাজ।

এতে কাজের গুণগত মান এবং স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। পটিয়া পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর গোফরান রানা ফেসবুক লাইভে যুক্ত হয়ে ও পোস্ট দিয়ে বলেন, এক্সকাভেটর দিয়ে মাইলের পর মাইল কৃষিজমির মাটি লুট ও খাল খননের নামে ফসলি জমি ভরাট করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, সরকার তো কারো ক্ষতি করে উন্নয়ন করতে বলেনি, মানুষের পেটে লাথি মারতে বলেনি। সরকার তো জনগণের ক্ষতিপূরণ ও উন্নতমানের কাজের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।

এই টাকা লুটপাট করছেন এরা কারা? জনগণ জানতে চায়? খাল খননের নামে মানুষের জমি কেটে অথবা ভরাট করে কৃষিজমির ফসল নষ্ট করে, বিভিন্ন ফলজ ও বনজ গাছ কেটে, ক্ষতিপূরণ না দিয়ে মানুষের ওপর জুলুম করা হচ্ছে।

তিনি অভিযোগ করেন, খালের প্রস্থ ৮৫ ফুট, গভীরতা ১৬ থেকে ১৮ ফুট এবং তলা ২০ ফুট হওয়ার কথা থাকলেও খাল খননে এই নিয়ম মানা হয়নি। খালের কোথাও ১৩০, কোথাও ১২০ ফুট প্রশস্ততাও রয়েছে।

পটিয়া পৌরসভার সুচক্রদণ্ডী গ্রামের ভুক্তভোগী মফিজুর রহমান জানান, সিন্ডিকেটের বাইরে পটিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডে কেউ কাজ করতে পারেন না। সিন্ডিকেটকে শতকরা পাঁচ থেকে দশ ভাগ হারে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে সাধারণ ঠিকাদারদের কাজ করতে হয়।

টাকা না দিলে প্রকৃত যোগ্য ঠিকাদারকে বাদ দেওয়া হতো। জনপ্রতিনিধির ছত্রছায়ায় ঠিকাদার ও পাউবোর কতিপয় কর্মকর্তার কমিশন ও টেন্ডার বাণিজ্যের কারণে পটিয়ার মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পাউবোর হাজার কোটি টাকার প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে।

আমি কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ পাইনি। অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে নাইখাইন এলাকার বাসিন্দা নাজমুল হোসেন জানান, বিগত ১৫ বছর সিন্ডিকেটের সঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কয়েকজন প্রকৌশলী পরস্পর যোগসাজশে হুইপ সামশুল হকের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে উন্নয়নের নামে লুটপাট করেছে। ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে পটিয়া পাউবোর প্রকল্পগুলোতে।

উন্নয়ন কাজে পাউবোর কোনো কর্মকর্তার তদারকি নেই বললেই চলে। পাউবোর প্রকল্প মানেই যেন দুর্নীতি ও অনিয়মের মহোৎসব। যতটুকু কাজ হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ চলে গেছে প্রকল্প সিন্ডিকেট ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের পকেটে। বিগত ১৫ বছর এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে উন্নয়নের নামে শুধু পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে কয়েকশ’ কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কয়েকজন প্রকৌশলী পরস্পর যোগসাজশে ভাগ-বাটোয়ারার অংশীদার হয়েছেন। কাজের মান নিয়ে উদাসীন কর্তৃপক্ষ। এই কাজ নিয়ে এলাকাবাসীর যে স্বপ্ন ছিল, তা বিলীন হতে চলেছে।

শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ বেশি দরে প্রাক্কলন তৈরি করে টেন্ডারবাজি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্থানীয় প্রতিবাদকারীদের হুমকি-ধমকি দিয়ে নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করছেন সিন্ডিকেটের সদস্যরা। আমি ক্ষতিপূরণ দাবি করে প্রতিবাদ করায় আমাকে পটিয়া থানার পুলিশ দিয়ে তুলে নিয়ে মিথ্যা রাজনৈতিক মামলা দিয়ে জেলহাজতে পাঠিয়েছে।

হাইদগাঁও এলাকার সচেতন নাগরিক আজাদ হাসান রিপন জানান, নিয়মিত দুর্ভোগ পোহাতে হয় শ্রীমাই খাল এলাকার বাসিন্দাদের। নির্মাণস্থলে কাজের বিবরণ সংবলিত কোনো সাইনবোর্ড টাঙানো হয়নি। গভীর নলকূপের পানির পরিবর্তে ঢালাইয়ে ব্যবহার হচ্ছে শ্রীমাই খালের পানি। তা ছাড়া ঢালাইয়ে কেমিক্যাল ব্যবহারের নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না।

মাঝেমধ্যে ইঞ্জিনিয়ার গেলেও তাদের সামনে প্রকাশ্যে চলছে এসব কাজ। জঙ্গলখাইন ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের নজরুল ইসলাম, আবদুল হক, আবদুল হাকিম জানান, ধানের চারা রোপণ করেছে এমন জমিতে চালানো হয় এক্সকাভেটর। জমির মালিকদের প্রথমে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা হলেও এ পর্যন্ত তারা কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি।

এখানকার ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকরা অভিযোগ করেছেন, একদিকে অধিগ্রহণ ছাড়াই তাদের জমি বেড়িবাঁধের ভেতরে ঢোকানো হয়েছে, অন্যদিকে আবাদি জমিতে পুকুরের মতো খনন করে মাটি তুলে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এক্সকাভেটর দিয়ে পুকুরের মতো বড় বড় গর্ত করে কৃষিজমি থেকে মাটি নিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে বাঁধ। আবার কোনো কোনো জায়গায় ভরাট হওয়া খালের মাটি ফেলে ভরাট করা হচ্ছে ফসলি জমি।

এ বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য ঠিকাদার মনিরুজ্জামানকে ফোন করলে তিনি রিসিভ করেননি। পাউবো চট্টগ্রাম পওর বিভাগ-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত ইবনে সাহীদ জানান, আমরা পাথর, বালি, সিমেন্ট ইত্যাদি নির্মাণসামগ্রী টেস্ট করেছি এবং প্রকল্প সাইট ও তৈরীকৃত ব্লক সরেজমিনে পরিদর্শন করেছি। আমাদের কাছে সন্তোষজনক মনে হয়েছে।

তা ছাড়া সিসি ব্লকগুলো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দ্বারা গঠিত  টাস্কফোর্সের মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বুয়েটে পাঠানো হয়। প্রকল্প পরিচালক খ ম জুলফিকার তারেক জানান, আমার জানা মতে এ রকম হওয়ার কথা না, ঢালাইয়ে রেডিমেড ব্যবহার করার কথা। কেন ম্যানুয়েল ব্যবহার হচ্ছে তা খতিয়ে দেখব। তা ছাড়া তদন্ত করে কোনো অনিয়ম দেখলে সঙ্গে সঙ্গে কাজ বন্ধ করে দেব।

এই বিভাগের আরও খবর