,

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে নিহত বেড়ে ৩৪

নিজস্ব প্রতিবেদক: ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে নৌকাডুবি ও সৃষ্ট ঝড়ে গাছ পড়ে ৩৪ জন নিহত হয়েছেন সোমবার (২৪ অক্টোবর) সন্ধ্যা থেকে মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) ভোর পর্যন্ত এসব ঘটনা ঘটে।

নিহতের মধ্যে কুমিল্লায় তিনজন, সিরাজগঞ্জে দু’জন, ভোলায় চারজন, গোপালগঞ্জে দুজন, চট্টগ্রামে ৮ জন ও নড়াইল, শরীয়তপুর, বরগুনা, ঢাকায় একজন করে নিহত হয়েছেন।

ঝড়ের প্রভাবে চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগের বেশির ভাগ জায়গায় ঝড়ো বাতাস ও ভারী বৃষ্টি হয়েছে। সমুদ্র উপকূলের ১৫টি জেলার নদ–নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ থেকে ৫ ফুট উচ্চতা নিয়ে বয়ে গেছে।

প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

কুমিল্লায় একই পরিবারের ৩ জনের মৃত্যু

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার হেশাখালে গাছ উপড়ে একই পরিবারের ৩ জন নিহত হয়েছেন। সোমবার (২৪ অক্টোবর) রাত ৯ টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন হেশাখাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইকবাল বাহার মজুমদার।

নিহতরা হলেন, ওই এলাকার নিজাম উদ্দিন, তার স্ত্রী সাথি আক্তার ও কন্যাশিশু লিজা। এ ব্যাপারে চেয়ারম্যান ইকবাল বাহার মজুমদার বলেন, এখনও ঝড়ের তাণ্ডব চলছে, তাই ঘটনাস্থলে যেতে পারছি না। শুনেছি ঘরে একজন ও হাসপাতালে নেওয়ার পর দুজন মারা গেছে।

সিরাজগঞ্জে মা-ছেলের মৃত্যু

সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়নের পূর্বমোহন ও শিল্পপার্কের মাঝখানে যমুনা নদীর ক্যানেলে সিত্রাংয়ের প্রভাবে নৌকা ডুবে মা ও ছেলের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। পূর্বমোহনপুর বাড়ি যাওয়ার পথে সোমবার (২৪ অক্টোবর) রাত নয়টার দিকে এ নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন, পূর্বমোহনপুর গ্রামের খোকনের স্ত্রী আয়েশা খাতুন (২৮) ও তার ছেলে আরাফাত হোসেন (২)।

ভোলায় ৪ জনের মৃত্যু

ভোলায় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে সদর, লালমোহন, চরফ্যাশন ও দৌলতখান উপজেলায় চারজন নিহত হয়েছেন।

সোমবার (২৪ অক্টোবর) রাতে তিনজন ও মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) ভোরের দিকে একজন নিহত হয়েছেন।

নিহত ব্যক্তিরা হলেন- ভোলা সদরের ধনিয়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের চেওয়াখালী গ্রামের মো. মফিজুল ইসলাম (৬০), চরফ্যাশন উপজেলার হাজারীগঞ্জ ইউনিয়নের মো. মনির হোসেন (৩০), লালমোহন উপজেলার লর্ডহাডিঞ্জ ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের রাবেয়া বেগম (২৫) ও দৌলতখান পৌর ৭ নম্বর ওয়ার্ডের খাতিজা বেগম (৬০)।

জানা গেছে, সদরের মফিজুল ইসলাম একটি গাছ ভেঙে বসতঘরের ওপরে পড়লে চাপা পড়ে নিহত হন। লালমোহনের রাবেয়া বেগম জোয়ারের পানিতে ডুবে নিহত হন। দৌলতখানের খাতিদা বেগমও ঘরের ওপর গাছ পড়ে চাপায় নিহত হন। এ ছাড়া চরফ্যাশনের হাজারীগঞ্জে মনির মোটরসাইকেল করে যাওয়ার সময় গাছের ডাল ভেঙে শরীরে পড়ে নিহত হন।

ভোলা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল ইসলাম ভোলা সদর ও দৌলতখানের হতাহতের তথ্যগুলো নিশ্চিত করেছেন।

চরফ্যাশন উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আল নোমান বলেন, চরফ্যাশনে একজন নিহত হয়েছেন। এখন পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক ঘর পুরো বিধ্বস্ত ও এক হাজারের অধিক ঘর আংশিক বিধস্ত হয়েছে।

এদিকে লালমোহন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাহাবুবুর রহমান জানান, লালমোহনে একজন নিহত হয়েছেন।

চট্টগ্রামে ৮ জনের মৃত্যু চট্টগ্রাম উপকূলে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে বালুবোঝাই ড্রেজার ডুবির ঘটনায় আট শ্রমিকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

এর আগে সোমবার (২৪ আগস্ট) রাত ৮টার দিকে মীরসরাই উপজেলার শায়েরখালী ইউনিয়নে বঙ্গবন্ধু ইকোনমিক জোনে বসুন্ধরা গ্রুপের তিন নম্বর জেটি সংলগ্ন সাগরে ড্রেজারটি ডুবে যায়।

মারা যাওয়া শ্রমিকরা হলেন- ইমাম মোল্লা, মাহমুদ মোল্লা, শাহীন মোল্লা, আল আমিন, মো. তারেক ও বাশার। অন্য দুজনের নাম জানা যায়নি। তবে ড্রেজারটি থেকে এক শ্রমিক তীরে আসতে সক্ষম হয়েছেন। ওই শ্রমিকদের সবার বাড়ি পটুয়াখালী সদর উপজেলার জৈনকাঠী এলাকায়।

ড্রেজারটি থেকে বেঁচে ফেরা শ্রমিক মো. সালাম জানান, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে তীব্র বাতাস ও ঢেউ ওঠায় সৈকত-২ নামে তাদের ড্রেজারটি মিরসরাই উপকূলের সন্দ্বীপ চ্যানেলে ডুবে যায়। ড্রেজারটির মালিক সৈকত এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে নিয়োগ দিয়েছে বেপজা। ড্রেজারটিতে থাকা ৯ শ্রমিকের মধ্যে তিনি কিনারে আসতে পারলেও বাকি ৮ শ্রমিক আটকা পড়েন।

ঢাকায় রিকশাচালকের মৃত্যু সিত্রাংয়ের প্রভাবে বৃষ্টি আর ঝড়ের মধ্যে ঢাকার হাজারীবাগে দেয়াল ধসে এক রিকশাচালকের মৃত্যু হয়েছেন। এ সময় আহত হয়েছেন এক মোটরসাইকেল চালক।

সোমবার (২৫ অক্টোবর) সন্ধ্যায় জিগাতলার মনেশ্বর রোডে এ ঘটনা ঘটে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বাচ্চু মিয়া জানান, স্থানীয় লোকজন দুজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে এলে রিকশাচালককে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। সোমবার রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ওই ব্যক্তির নাম পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি। আহত মোটরসাইকেল চালককে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

বরগুনায় শতবর্ষী বৃদ্ধা নিহত

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে বরগুনার সদর উপজেলার সোনাখালী এলাকার আমেনা খাতুন নামের শতবর্ষী এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। সোমবার (২৪ অক্টোবর) রাত আটটার দিকে তার ঘরের ওপর গাছ পড়লে ভেতরে চাপা পড়ে তিনি মারা যান। এ ব্যাপারে বরগুনার সোনাখালী এলাকার সমাজকর্মী এনামুল হক ওরফে শাহীন বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে তাঁদের এলাকায় নিহত আমেনা খাতুনের বয়স ১০০ বছরের বেশি।

শরীয়তপুরে গাছ পড়ে বৃদ্ধা নিহত

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে ঝড়ো বাতাসে ঘরের ওপর গাছ পড়ে শরীয়তপুরের জাজিরায় সাফিয়া খাতুন (৬৫) নামে এক নারী নিহত হয়েছেন। সোমবার (২৪ অক্টোবর) সন্ধ্যার দিকে এ ঘটনা ঘটে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. কামরুল হাসান সোহেল।

নড়াইলে মৃত্যু একজনের

ঝড়ো হাওয়ায় গাছের ডাল ভেঙে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলায় এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। সোমবার দুপুরে উপজেলা পরিষদ চত্বরে এ ঘটনা ঘটে বলে লোহাগড়া থানার ওসি মো. নাসির উদ্দীন জানান। নিহত মর্জিনা বেগম (৪০) বাগেরহাট সদর উপজেলার অর্জনবাহার গ্রামের বাসিন্দা। তিনি গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন।

গোপালগঞ্জ ২ নারী নিহত

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলায় সিত্রাংয়ের প্রভাবে গাছচাপায় দুই নারী নিহত হয়েছে।

মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) দুপুরে টুঙ্গিপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবুল মনসুর এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এর আগে সোমবার (২৪ অক্টোবর) রাতে উপজেলার পাঁচকাহনিয়া ও বাঁশবাড়িয়ার চরপাড়া গ্রামে এ পৃথক ঘটনা ঘটে।

নিহত ব্যক্তিরা হলেন, বাঁশবাড়িয়ার চরপাড়া গ্রামের হান্নান তালুকদারের স্ত্রী রোমেছা বেগম (৫৮) ও পাঁচকাহনিয়া গ্রামের রেজাউল খার স্ত্রী সারমিন বেগম (২৫)।

টুঙ্গিপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবুল মনসুর জানান, সিত্রাংয়ের প্রভাবে সোমবার রাত সোয়া ৮টার দিকে টুঙ্গিপাড়া উপজেলার বাঁশবাড়িয়ার চরপাড়া গ্রামের হান্নান তালুকদারের ঘরের ওপর চম্বল গাছ উপড়ে পড়ে গাছচাপা পড়ে তার স্ত্রীর মৃত্যু হয়। অন্যদিকে সোমবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে একই উপজেলার পাঁচকাহনিয়া গ্রামে রেজাউল খার বাড়ির পাশে থাকা খেজুর গাছ তার বসত ঘরে উপড়ে পড়ে। এ সময় ঘরে থাকা তার স্ত্রী সারমিন বেগম গাছচাপা পড়ে ঘটনাস্থলে নিহত হন।

গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক শাহিদা সুলতানা জানান, নিহতদের দাফন কাফনের জন্য ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্তদের বসত ঘর ঠিক করে দেয়া হবে। এ ছাড়া জেলার অন্য কোথাও কারোর ঘরবাড়ি ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাদেরকেও ক্ষতি পূরণের ব্যবস্থা করা হবে।

এদিকে, প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, সোমবার দিবাগত রাতেই ঘূর্ণিঝড়টি রাজধানীর ওপর দিয়ে সিলেট হয়ে ভারতে প্রবেশ করবে। এ সময় এটি স্থল নিম্নচাপে পরিণত হবে। তবে ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাবে সাগর উত্তাল রয়েছে। ঝড়ের প্রভাবে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত উপকূলসহ দেশের বেশির ভাগ এলাকাজুড়ে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হতে পারে।

ঝড়ো হাওয়া ও ভারী বৃষ্টির আশঙ্কায় আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে চট্টগ্রাম, পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দর এবং কক্সবাজার উপকূলসহ দেশের ১৫টি উপকূলীয় জেলাকে ৭ নম্বর বিপৎসংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর