নিজস্ব প্রতিবেদক, বিডিনিউজ ১০ ডটকম: জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিচার চলবে- এ মর্মে হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে করা আপিল আবেদনের আদেশ হবে আজ। রোববার এ আপিল আবেদনের শুনানি শেষে আদেশের দিন ধার্য করেছেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ আদেশের জন্য এ দিন নির্ধারণ করেন। আপিলের আবেদন খারিজ হলে আজ বিচারিক আদালতে মামলাটির রায় ঘোষণা হতে পারে।
এর আগে ১৬ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার যুক্তিতর্ক কার্যক্রম সমাপ্ত ঘোষণা করে রায় ঘোষণার দিন (আজ সোমবার) ধার্য করেন বিচারিক আদালত। পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে স্থাপিত ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান এ আদেশ দেন। মামলায় ৪৬ কার্যদিবস যুক্তিতর্ক এবং মামলা দায়েরের সাত বছর দুই মাস ২১ দিন পর চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করা হয়।
এ মামলার চার আসামির মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে আছেন খালেদা জিয়া। অন্য দুই আসামি বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ-নিরাপত্তা ও প্রাফিক বিভাগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান কারাগারে আছেন। আরেক আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব আবুল হারিছ চৌধুরী পলাতক রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি আছে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজা হয়ে কারাগারে যাওয়ার পর থেকে খালেদা জিয়া ৫ সেপ্টেম্বর ছাড়া আর একবারও আদালতে হাজির হননি। এজন্য দুদক প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়ার উপস্থিতি ব্যতিরেকেই বিচার চালিয়ে যাওয়ার আবেদন করা হয়। আবেদনের শুনানি শেষে ২০ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়ার উপস্থিতি ছাড়াই এ মামলার বিচার চলবে বলে আদেশ দেন বিচারিক আদালত। আদেশে আদালত বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া আদালতে হাজির হয়ে ৫ সেপ্টেম্বর বলেছেন তিনি বারবার আদালতে আসতে পারবেন না। এরপর ১২ ও ১৩ সেপ্টেম্বর এবং আজও (২০ সেপ্টেম্বর) খালেদা জিয়া কারাগার কর্তৃপক্ষকে বলেছেন তিনি আদালতে আসতে অনিচ্ছুক। এমতাবস্থায় পিপির পিটিশন গ্রহণ না করলে বিচার বিলম্বিত হবে। অর্থাৎ আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয় যে, খালেদা জিয়া আদালতে আসতে অনিচ্ছুক। ন্যায়বিচারের স্বার্থে খালেদা জিয়াকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিয়ে তাকে জামিনে রেখে বিচার চলবে।’ এরপর ২৭ সেপ্টেম্বর এ আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিভিশন আবেদন করা হয়। সেই রিভিশন আবেদন ১৪ অক্টোবর খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। এরপর ওই খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে এ আপিল আবেদন করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগে ২০১১ সালের ৮ আগস্ট রাজধানীর তেজগাঁও থানায় মামলাটি দায়ের করে দুদক। তদন্ত শেষে ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি খালেদা জিয়াসহ চারজনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করা হয়। এরপর ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়। ২০১৫ সালের ৫ মে এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। উচ্চ আদালতের আদেশে সাক্ষীদের ‘রিকল’ করায় ২০১৭ সালের ২৬ অক্টোবর এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম শেষ হয়। ২০১৬ সালের ১ ডিসেম্বর এ মামলায় নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবি করে আত্মপক্ষ সমর্থনে আদালতে বক্তব্য উপস্থাপন করেন খালেদা জিয়া। ওই বছরের ২১ ডিসেম্বর এ মামলার যুক্তিতর্ক কার্যক্রম শুরু হয়। ওই সময় জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা ছাড়াও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার শুনানি একসঙ্গে চলেছে। সে সময় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার যুক্তিতর্ক কার্যক্রম অগ্রসর হলেও এ মামলার যুক্তিতর্ক তেমন অগ্রসর হয়নি।
৩০ জানুয়ারি এ মামলায় খালেদা জিয়াসহ সব আসামির সর্বোচ্চ সাজা অর্থাৎ সাত বছর কারাদণ্ড দাবি করে দুদক প্রসিকিউশন। এরপর থেকে দীর্ঘদিনেও আসামিপক্ষ যুক্তিতর্ক কার্যক্রম সমাপ্ত না করায় অবশেষে রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন আদালত। মামলায় মোট ৩৬ জন সাক্ষীর মধ্যে ৩২ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে।
২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর দুর্নীতির এ মামলায় খালেদা জিয়া হাজির না হলে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন আদালত। এরও আগে ২০১৬ সালের ১২ অক্টোবর বিদেশে থাকাকালে খালেদা জিয়ার জামিন বাতিল করে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। বর্তমানে কারাগারে থাকলেও এ মামলায় তিনি অস্থায়ী জামিনে আছেন।
আপিল খারিজ হলে রায় ঘোষণা সম্ভব : খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিচার চলবে- এ মর্মে বিচারিক আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে করা আপিল আবেদন খারিজ হলে বিশেষ জজ আদালত-৫-এ আজ সোমবারই এ (জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট) মামলার রায় ঘোষণা সম্ভব হবে। রোববার নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ কথা বলেন। তিনি বলেন, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা শুনানির সময় খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে প্রায় ৪০ বার সময় নেয়া হয়েছে। তারপর যখন আসামিপক্ষের বক্তব্য শোনার জন্য তারিখ নির্ধারণ করা হল, তখন তিনি প্রায় ৩২ বার সময় নিয়েছেন। এরপর বেশ কিছুদিন তিনি জেলে থাকাবস্থায় আদালতে যেতে পারেননি। বলা হল তিনি অসুস্থ। তারপর একটি তারিখে তিনি (খালেদা জিয়া) জানিয়েছেন, তিনি আদালতে যাবেন না। এই পরিস্থিতিতে বিজ্ঞ বিচারক তার অনুপস্থিতিতেই এ মামলার যুক্তিতর্কের শুনানির দিন ধার্য করেছেন। কিন্তু সেই সময়ও উনার ১২৬ জন আইনজীবীর কেউই আদালতে যাননি। এ অবস্থায় মামলাটিতে বিচারিক আদালত সোমবার রায়ের জন্য ধার্য করেছেন। এরই মধ্যে খালেদা জিয়ার পক্ষে আপিল বিভাগে আবেদন করা হয়েছে। আজ (রোববার) শুনানির পরে আগামীকাল (আজ সোমবার) আদেশের জন্য রাখা হয়েছে। খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিচারিক আদালত মামলার চলার যে আদেশ দিয়েছিলেন, তার বিরুদ্ধে তারা হাইকোর্টে রিভিশন আবেদন করেছিলেন। কিন্তু হাইকোর্টেও রায় উনার বিপক্ষে গেছে। তার বিরুদ্ধে আজ (রোববার) আপিল বিভাগে এ মামলার শুনানি হল। যদি এ মামলার আপিলে নিয়মিত আপিল করার অনুমতি দেয়া হয়, তাহলে বিচারিক আদালত কর্তৃক মামলার রায় প্রদান অনিশ্চিত হয়ে যাবে। আর যদি খালেদা জিয়ার আবেদনটি আপিল বিভাগে খারিজ হয়ে যায়, তবে আগামীকাল (আজ সোমবার) রায় দেয়া সম্ভব হবে।
বিচারিক আদালত যা বলেছেন : মামলার যুক্তিতর্ক কার্যক্রম সমাপ্ত ঘোষণা করে ১৬ অক্টোবর এ মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন আদালত। ওই সময় আদালত বলেন, আড়াই বছর ধরে এ মামলার যুক্তিতর্ক শুনানির দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু বারবার সময় দেয়ার পরও আসামিপক্ষ যুক্তিতর্ক শুনানিতে অংশ নেয়নি। তারা (আসামিপক্ষ) যুক্তিতর্ক শুনানি না করে নানা কারণ দেখিয়ে কালক্ষেপণ করছে। যদিও মামলাটিতে যুক্তিতর্ক শুনানির সুযোগ নেই। তবুও আসামিপক্ষকে তা (যুক্তিতর্ক উপস্থাপন) করার জন্য বলা হয়। উচ্চ আদালত খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিচারকার্য চলার জন্য আদেশ দিয়েছেন। এরপরও আসামিপক্ষ যুক্তিতর্ক পেছানোর জন্য সময়ের আবেদন করেছেন। এরপর আদালত আসামিপক্ষের সময় আবেদন নামঞ্জুর করে রায় ঘোষণার দিন (আজ সোমবার) ধার্য করেন এবং রায় ঘোষণার দিন পর্যন্ত খালেদা জিয়ার জামিন বহাল রাখেন।
চার্জশিটে যা বলা হয়েছে : ট্রাস্টের অ্যাকাউন্টে টাকা প্রাপ্তি ও জমা দেয়া এবং উত্তোলনের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি সম্পূর্ণটাই সন্দেহজনক। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে সরকারি বাসভবনের ঠিকানা ব্যবহার করে ট্রাস্টের রেজিস্ট্রি করেন। তিনি তার রাজনৈতিক সচিব ও অন্যদের দিয়ে ট্রাস্টের ওই অ্যাকাউন্টে অবৈধভাবে টাকা সংগ্রহ ও লেনদেন করেন। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ওই অ্যাকাউন্টে লেনদেন হলেও প্রধানমন্ত্রী বহাল না থাকার পর ওই অ্যাকাউন্টে আর কোনো লেনদেন হয়নি। ওই ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে মোট ১ কোটি ৯০ লাখ ৫০ হাজার টাকা বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় জমা করেন। আর জমির দলিলমূল্যের চেয়েও ১ কোটি ২৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা জমি বিক্রেতাকে প্রদান দেখিয়েছেন। অর্থাৎ ওই ট্রাস্টের অ্যাকাউন্টে মোট ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা আসামিরা পরস্পর যোগাসাজশে অবৈধভাবে সংগ্রহ করেন, জমা করেন এবং খরচ করেন। ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা এবং দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় আসামিদের বিরুদ্ধে এ চার্জশিট দাখিল করা হয়।
আত্মপক্ষ সমর্থনে যা বলেছেন খালেদা জিয়া : ২০১৬ সালের ১ ডিসেম্বর এ মামলায় খালেদা জিয়া আত্মপক্ষ সমর্থনে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে আদালতে বক্তব্য উপস্থান করেন। আত্মপক্ষ সমর্থনে খালেদা জিয়া বলেন, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের কোনো কাজই আমি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে করিনি। এর সঙ্গে সরকারি বা রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মচারী জড়িত নয়। কাউকে কোনো সুবিধা দিয়ে বা বাধ্য করে ট্রাস্টের জন্য টাকা নেয়া হয়নি। সে ধরনের কোনো অভিযোগও নেই। তবুও আমাকে হেয় ও হেনস্তা করার উদ্দেশ্যেই কেবল এ মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ মামলা দায়েরের ফলে আমি চলমান এক অসঙ্গত পরিস্থিতির শিকার মাত্র। আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের (দুদক) কোনো সাক্ষী অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস পাওয়ার যোগ্য।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ৮ ফেব্র“য়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও আর্থিক জরিমানা করা হয়। একই সঙ্গে তার বড় ছেলে তারেক রহমানসহ পাঁচ আসামিকে ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং প্রত্যেককে ২ কোটি ১০ লাখ টাকা করে জরিমানা করে রায় ঘোষণা করেন বিচারিক আদালত। রায় ঘোষণার পরপরই খালেদা জিয়াকে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়। সেখান থেকে সম্প্রতি তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নেয়া হয়েছে। সেখানে তিনি চিকিৎসাধীন।