আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ইউক্রেনে ক্রমেই বাড়ছে যুদ্ধের তীব্রতা। হামলা বাড়াচ্ছে রুশ বাহিনী। নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে শহর। গোলা পড়ছে আবাসন-বিদ্যালয়ে। বাড়ছে বিমান হামলা। রাজধানী কিয়েভ ঘিরে অগ্রসর হচ্ছে মস্কোর সেনারা। পক্ষান্তরে প্রবল প্রতিরোধ গড়ছে ইউক্রেনীয়রা। যুদ্ধকবলিত অবরুদ্ধ বিভিন্ন শহরে খাবার ও পানির হাহাকারে ভারি হচ্ছে ইউক্রেনের আকাশ। বাড়ছে উদ্বাস্তু; তীব্রতর হচ্ছে মানবিক সংকট। এ পর্যন্ত অন্তত ৪৪ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। হামলা থেকে জীবন বাঁচাতে দেশ ছেড়েছে কমপক্ষে ২৫ লাখ মানুষ।
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় শরণার্থীর ঢল বেড়েছে। শুক্রবার আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম জানায়, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি হামলা শুরুর পর এ পর্যন্ত ২৫ লাখের বেশি মানুষ ইউক্রেন ছেড়েছে। এর আগে ৮ মার্চ জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি জানিয়েছিলেন, ওই দিন পর্যন্ত ২০ লাখ মানুষ ইউক্রেন ছেড়েছিল। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণভাবে অন্তত ১৮ লাখ ৫০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের কো-অর্ডিনেশন ফর হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাফেয়ার্স। গতকাল রাশিয়া অবরুদ্ধ পাঁচটি মানবিক করিডোর চালু করে। বেসামরিক লোকদের সরিয়ে দিতে এসব পদক্ষেপ নেয় তারা। তবে করিডোর পথে বোমাবর্ষণের অভিযোগ করেছে কিয়েভ।
ইউক্রেনে হামলার পর বিভিন্ন শহর দখলে নেয় রাশিয়া। এসব অবরুদ্ধ শহরে যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন থাকায় মানবিক সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। মারিউপোল, খারখিভসহ কয়েকটি শহরে খাবার ও পানির ভয়াবহ সংকট দেখা দিয়েছে। স্থানীয়রা এএফপিকে জানিয়েছে, খাবার ও পানীয় ছাড়া ঠিক কতদিন বাঁচতে পারব, জানা নেই! এরই মধ্যে রুশ হামলায় চেরনিহিভের প্রধান পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে সেখানে পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। হামলা শুরুর পর থেকে দলে দলে মানুষ ইউক্রেন ছেড়ে পালাচ্ছে। জাতিসংঘ জানায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অল্প সময়ের ব্যবধানে এত শরণার্থীর ঢল এর আগে দেখেনি ইউরোপ। দেশছাড়া বেশিরভাগ মানুষ প্রতিবেশী পোল্যান্ডে আশ্রয় নিচ্ছে।
হামলা শুরুর পর থেকে যুদ্ধবিরতির জন্য জোর তৎপরতা চলছে। বৃহস্পতিবার তুরস্কে ইউক্রেন-রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে বিশেষ অগ্রগতি না হওয়ায় দেশটির বড় বড় শহর-নগরে আক্রমণ শুরু করেছে রুশ বাহিনী। কিয়েভের কাছে সপ্তাহের বেশি সময় ধরে অবস্থান করা ৪০ মাইল দীর্ঘ রুশ ট্যাঙ্কের বহর অগ্রসর হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি মহাকাশ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্সার টেকনোলজিস দাবি করেছে, রুশ বহরটি ভাগ হয়ে এখন কিয়েভের আশপাশ এলাকায় অবস্থান নিয়েছে। এসব এলাকায় নিজেদের অবস্থান জোরদার করছে তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেন, ওই বহরটি রাজধানী অভিমুখে এগিয়ে শহর থেকে মাত্র ৩ মাইল দূরে অবস্থান করছে। এর মানে, কিয়েভের উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে অগ্রসর হতে থাকা রুশ বহরটি শহরের কেন্দ্র থেকে এখন মাত্র ৯ মাইল দূরে রয়েছে। এ ছাড়া এই প্রথমবারের মতো তারা দেশটির পশ্চিমাঞ্চল তথা লভিভ শহরের দিকে অগ্রসর হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তারা এখন চারপাশ থেকে রাজধানী ঘিরে অবস্থান করছে। এতে উত্তরাঞ্চলীয় শহর চেরনিহিভ এখন একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
এর পাশাপাশি বৃহস্পতিবার রাত ও শুক্রবার গোলাবর্ষণ, হামলা বাড়িয়েছে মস্কো। গতকাল নতুন করে ইউক্রেনের তিন শহর আক্রান্ত হয়েছে। দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর লুটস্ক, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় শহর দিনিপ্রো ও ইভানো-ফ্রাঙ্কিভস্কে বিস্ফোরণ এবং হামলা হয়েছে। এ ঘটনায় লুটস্ক শহরে দুই ইউক্রেনীয় সেনা এবং দিনিপ্রোর নোভোকোদাৎস্কিতে একজন নিহত হয়েছে। এ ছাড়া ইউক্রেনের একটি পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রেও হামলার অভিযোগ উঠেছে। এরই মধ্যে মস্কো দাবি করেছে, বিদ্রোহীরা ভলদোভাখা শহর দখলে নিয়েছে। এ ছাড়া খারকিভসহ বহু শহরে রুশ বাহিনীর হামলা জোরদারের খবর পাওয়া গেছে। দিনিপ্রোর স্থানীয় জরুরি বিভাগ জানায়, গতকাল ভোরে শহরে তিনটি বিমান হামলা হয়। একটি কিন্ডারগার্টেন ও একটি আবাসিক ভবনে গোলার আঘাত লাগে। বিমান হামলায় একটি জুতার কারখানায়ও আগুন ধরে যায়। এ পর্যন্ত রাশিয়া ইউক্রেনজুড়ে সাড়ে সাতশর মতো ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে বলে দাবি করেছে কিয়েভ। এ সময় রুশ সেনারা হামলা চালিয়ে অন্তত তিনশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে।
১৬ দিনে ৭৮শিশুসহ অন্তত সাড়ে পাঁচশ বেসামরিক নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।
এরই মধ্যে গতকাল রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে স্বেচ্ছাসেবকরা অংশ নিলে স্বাগত জানাবে মস্কো। এর আগে থেকে মার্কিন কর্মকর্তারা অভিযোগ করে আসছেন, সিরিয়া যুদ্ধে অংশ নেওয়া দক্ষ যোদ্ধাদের এই যুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে মস্কো। এদিন রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু বলেন, যুদ্ধের জন্য মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভাড়াটে (স্বেচ্ছাসেবক) সেনা আনা যেতে পারে। এ জন্য অন্তত ১৬ হাজার সেনা প্রস্তুত।
এ পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের কোনো শহর আর নিরাপদ নেই বলে জানিয়েছেন দেশটির সাংসদ ইনা সভসুন। তিনি বলেন, আমরা অবশ্যই আমাদের শিশুদের জীবন নিয়ে আতঙ্কিত; কিন্তু আমাদের করার তেমন কিছু নেই। আমরা আত্মসমর্পণ করতে পারি না। আমরা তাদের দখলও করতে দিতে পারি না। আমরা লড়াই অব্যাহত রাখব।
ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেক্সি রেজনিকভ বলেছেন, রাশিয়ার হামলায় সেনাদের চেয়ে বেসামরিক নাগরিক বেশি মারা গেছে। আমি চাই- এই বার্তা শুধু কিয়েভ নয়, সারাবিশ্বের কাছে যেন পৌঁছে।
কিয়েভের মেয়র সব নাগরিককে শহর রক্ষায় অস্ত্র তুলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আগে থেকে ইউক্রেনীয়রা অস্ত্র নিয়ে শহরের সুরক্ষা দিচ্ছে। মূলত শহরটি এখন দুর্গে পরিণত হয়েছে। রুশ অভিযানের প্রথম দিন তাদের সেনারা কিয়েভে প্রবেশ করলেও প্রতিরোধের মুখে পড়ে। মূলত ইউক্রেনীয়দের মানব-প্রতিরোধের মুখে পড়ে সে সময়ে পিছু হটে রুশ বাহিনী। এ যুদ্ধে ইউক্রেনে সেনা পাঠিয়ে সরাসরি অংশ না নিলেও দফায় দফায় অস্ত্র ও অর্থ দিচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব।
যুদ্ধে সরাসরি ইউক্রেনকে সেনা দিয়ে সহায়তা না করলেও নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাশিয়ার অর্থনীতি দুর্বল করার মাধ্যমে যুদ্ধবিরতিতে বাধ্য করার পদক্ষেপ নিয়েছে পশ্চিমারা। গতকাল মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নতুন করে রাশিয়ার ভদকা, সামুদ্রিক খাদ্য ও হীরার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। এ সময় তিনি মস্কোর সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যবসা বন্ধের আহ্বান জানান। তবে সরাসরি যুদ্ধে না জড়ানোর ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ন্যাটো ও রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হওয়া মানে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এদিন মস্কোর ওপর চতুর্থ ধাপের নিষেধাজ্ঞার পরিকল্পনা ঘোষণা করে ইইউ।
বৃহস্পতিবার বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেনকে অস্ত্র কিনতে ১৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন অর্থ দেওয়ার বিল পাস করেছে। এদিন কিয়েভকে সহায়তায় ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের জরুরি তহবিলের অনুমোদন দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এ ছাড়া দেশটির সামরিক বাহিনীর সহায়তার জন্য দ্বিগুণ অর্থ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে ইইউ। স্থানীয় সময় শুক্রবার এটি পাস হওয়ার কথা রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের ট্যাঙ্ক, বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রসহ নানা ধরনের যুদ্ধাস্ত্র দিচ্ছে দেশটি। এসব অস্ত্রে প্রবল প্রতিরোধ গড়ছে কিয়েভ বাহিনী। প্রতিরোধে আত্মপ্রত্যয়ী জেলেনস্কি গতকাল বলেন, এখন যুদ্ধে কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে কিয়েভ এবং মস্কোর আক্রমণকে পরাস্ত করবে। খবর বিবিসি, আলজাজিরা ও রয়টার্সের।