,

কর্তার অফিসে ঘুষের হাট! ভিডিও ভাইরাল

জেলা প্রতিনিধি, বরগুনা: বরগুনার বেতাগীতে ঘুষের পাওয়ার হাউজ নামে পরিচিত পিআইও অফিস। সেই অফিসের ঘুষের মহানায়ক বেতাগী প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) জিএম ওয়ালিউল ইসলাম নিজেই। প্রকল্প পাশ করাতেই তার ঘুষের দর ২৫ লাখ টাকা। সম্প্রতি এমন এক ঘুষ বাণিজ্যের ভিডিও পাওয়া গেছে।

ঘুষ বাণিজ্যের ভিডিও থেকে জানা যায়, বরগুনা ও বেতাগী অফিসের দায়িত্বে থাকাকালীনই দুই উপজেলা থেকে ঘুষের নামে পুরো ৫০ লাখ টাকা লুটপাট করেন পিআইও ওয়ালিউল ইসলাম।

ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, বরগুনা সদর ও বেতাগী দুই উপজেলা মিলিয়ে  ১৩টি ছোট গার্ডার ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণের একটি প্যাকেজ প্রকল্প এনে দেবেন পিআইও যে প্রকল্পের মূল্য ১১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা এবং ওই প্রকল্পে তার কমিশন ২৫ লাখ টাকা। এ টাকা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অফিসের প্রধান কার্যালয়ের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার পিএ আবু তাহেরের মাধ্যমে গ্রহণ করেন পিআইও ওয়ালিউল।

পরে অফিসের মধ্যে টাকা পাঠানোর সময় পুরো ২৫ লাখ টাকা ছিনতাই হয়েছে বলে একটি নাটক তৈরি করেন।

এ ঘটনায় পিআইওকে অফিসের মধ্যেই অবরুদ্ধ করেন ৭ জন ঠিকাদার। আরো দেখা যায়, বেতাগী অফিস থেকেও হাজার টাকার নোটের কয়েকটি বান্ডিল ঠিকাদারদের কাছ থেকে পিআইও’র নির্দেশে আলাদা আলাদাভাবে গ্রহণ করেন অফিস সহকারী জসিম উদ্দিন ও তার পিওন ফারুখ মিয়া। এই পুরো দুইটি ঘটনার ৭ মিনিট ১১ সেকেন্ডের ভিডিও ভাইরাল হয়।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, পিআইও ওয়ালিউল ইসলাম অফিস কক্ষে ঘুষের হাট বসিয়ে নিজ নেতৃত্বে চালান কমিশন বাণিজ্য।

যেকোনো সরকারি প্রকল্পের বিল উত্তোলনে শতকরা হারে তিনি অফিস কক্ষেই ঘুষ নেন গুনে গুনে একাধিক জনপ্রতিনিধি ও ঠিকাদারদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ৪০ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচি প্রকল্পে অনুমোদিত বিল থেকে অফিসের খরচ বাবদ কমিশনের নাম করে তিনি গ্রহণ করেন ৩০ শতাংশ ঘুষ। যেকোনো প্রকল্পের বিল উত্তোলনে রয়েছে তার কমিশন বাণিজ্য।

এছাড়াও গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার, রক্ষণাবেক্ষণ টিআর, কাবিখা ও কাবিটা প্রকল্পগুলোতে ২০ শতাংশ কমিশন না পেলে কোনো বিলে স্বাক্ষর করেন না এই পিআইও। তবে কমিশন পেলে প্রকল্প পরিদর্শন করারও দরকার পরে না তার। সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক জুনের মধ্যেই সকল প্রকল্পের কাজ শেষ করেই বিল উত্তোলন করার কথা থাকলেও, জুনের আগে কাজ শেষ না হওয়া প্রকল্পের অর্থ ‘বাস্তবায়ন অফিস একাউন্ট’ হিসাব নম্বরে ব্যাংকে বিডি করে রাখেন। পরে ঠিকাদারদের ওই বিলের টাকা দেওয়ার সময় ৩০% কমিশন গ্রহণ করেন পিআইও ওয়ালিউল। এছাড়াও আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১ ও ২নং ধাপে নিম্নমানের কাজসহ অর্থের বিনিময়ে বিত্তবানদের ঘর দিয়েও সমালোচিত তিনি। ইউপি সদস্যরা বলেন, ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগসাজোশ করেই চলে তার ঘুষ বাণিজ্য ও অনিয়ম দুর্নীতি, ফলে তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের তদন্ত পর্যন্ত করা হয় না।

এছাড়াও জেলা প্রশাসক ও উপজেলা চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর জাল করা, মায়ের নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান খুলে সরকারি কাজ হাতিয়ে নেওয়া, ঠিকাদারের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণের সময় জনগণের হাতে আটকসহ অনিয়ম-দুর্নীতির পাহাড় সমান অভিযোগ রয়েছে পিআইও ওয়ালিউলের বিরুদ্ধে। বরগুনা সদর ও বেতাগী দুই উপজেলার দায়িত্বে থাকাকালীন মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও বরগুনা সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর জাল করে বিল উত্তোলন করে তোপের মুখে পরেও অদৃশ্য ক্ষমতায় স্বপদে বহাল আছেন তিনি। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পিআইও তার মায়ের নামের ‘মেসার্স কোহিনুর বেগম’ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে প্রথম বিজয়ী ঘোষণা করে ৩২ লাখ ৩৯ হাজার ৬৩৮ টাকার একটি কাজ আত্মসাৎ করেন।

২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের ত্রাণের অর্থায়নে ২ কোটি ১৩ লাখ ৭৬ হাজার টাকা ব্যয়ে উপজেলার হোসনাবাদে একটি সাইক্লোন সেল্টারের নির্মাণকাজ চলাকালীন ঠিকাদারের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ গ্রহণকালে এলাকাবাসী ঘুষের টাকাসহ পিআইওকে তালাবদ্ধ করে রাখেন। পরে উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তাকে উদ্ধার করেন। ওই কাজের ঠিকাদার এনায়েত হোসেন বলেন, বিভিন্ন পর্যায়ে বিল উত্তোলনে পিআইওকে প্রায় ১০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ঠিকাদার বলেন, ‘আমরা পিআইও ওয়ালিউল ইসলামরে কাছে জিম্মি। আমরা স্বল্প পুঁজি নিয়ে ঠিকাদারি কাজ করি। তারপর যখন বিল আটকে দেয় তখন বাধ্য হয়ে ঘুষ দেই। এতদিন এসব ভিডিও বাইরে প্রকাশ করিনি কারণ তাহলে আমাদের কাজের বিল নানা কৌশলে আটকে দিত পিআইও।

তিনি আরো বলেন, প্রতিটি কাজ ৫% লেস দিয়ে নিতে হয়, ভ্যাট আয়কর আছে ১০%, পিআইও ঢাকা অফিসের ঘুষের জন্য নেন ১০%, নিজ দপ্তরের জন্য রাখেন ৫%, এছাড়া ১০% থাকে জামানত। ১০০ টাকা থেকে যদি ৪০ টাকা এভাবেই চলে যায় তাহলে কি দিয়ে আমরা ভালোভাবে কাজ করব। আবার যদি টাকা না দেই তবে কাজও পাব না, আবার বিলও উত্তোলন হবে না।

বেতাগী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) জিএম ওয়ালিউল ইসলাম বলেন, ‘আমার ব্যাপারে কোনো অভিযোগ সত্য নয়। আজান হয়েছে আমি নামাজে যাব আমাকে বিরক্ত করবেন না। যা বলার আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বলব। এই বলে ফোন রেখে দেন।

বেতাগী ইউএনও মো. ফারুক আহমেদ বলেন, ‘অভিযোগগুলো শুনলাম তবে চাইলেই আমি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি না কারণ তিনি আমার অধীনে না, এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সঙ্গে আলোচনা করব।’

বরগুনা জেলা প্রশাসক মোহা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এ বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করা হবে এবং তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর