জেলা প্রতিনিধি, গোপালগঞ্জ: সেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন ইউপি চেয়ারম্যান। এলাকার বিভিন্ন সমস্যার সমাধান, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো, মাদক নিয়ন্ত্রণ, বালু উত্তোলন বন্ধসহ নানা কর্মকান্ডের দায়িত্ব চেয়ারম্যানের ওপর অর্পিত হয়। কিন্তু গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ফুকরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ ইশতিয়াক পটুর ক্ষেত্রে সেটা ব্যতিক্রম। তিনি নির্বাচিত হয়েই বেপরোয়া হয়ে উঠেন। গড়ে তোলেন সন্ত্রাসী বাহিনী। সেই বাহিনী দিয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। নিজেই জমি দখল, চাঁদাবাজি, নিরীহ লোকজনকে অত্যাচার, মাদক ব্যবসা ও মাদক সেবনসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতি এবং অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন। একদিকে চেয়ারম্যান, অন্যদিকে দিনাজপুরের সাবেক পুলিশ সুপার শাহ ইফতেখার আহমেদের ভাই। যে কারণে ক্ষমতার দম্ভে কাউকে পরোয়া করেন না তিনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইউপি নির্বাচনকালে পটুর বড় ভাই শাহ ইফতেখার আহমেদ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার ছিলেন। যার ক্ষমতা আর অবৈধভাবে উপার্জিত টাকায় উপজেলার মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যয়ে ‘ইউপি চেয়ারম্যান’ নির্বাচিত হয়েছেন পটু। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী আনিসুর রহমান খান জনপ্রিয়তায় এগিয়ে থাকলেও; অঢেল টাকার কাছে হেরে যান। এভাবেই পটু হয়ে ওঠেন ‘ক্ষমতাধর’ চেয়ারম্যান। জনগণের ওপর শুরু করেন জুলুম-অত্যাচার। এলাকায় যেন মূর্তিমান আতঙ্ক। তাঁর অন্য কোনো পেশা না থাকলেও; চড়েন ৩৫ লাখ টাকা দামের গাড়ি।
চেয়ারম্যান পটু উপজেলার পাংখারচর এলাকার সুচাইল মৌজায় প্রায় ৪০ বিঘা জমি নিয়ে করেছেন একটি মৎস্য ঘের। যেখানে দখল করা হয়েছে প্রায় ১০ বিঘা সরকারি খাস জমি এবং বিভিন্ন লোকজনের ব্যক্তি মালিকানা জমি। এমনই একজন ভূক্তভোগী তারাইল গ্রামের জাসু কাজী। তিনি জানিয়েছেন, ইউপি চেয়ারম্যান পটু মৎস্যঘের করার কথা বলে তাঁর ৩৮ শতাংশ জমি লীজ নিয়েছেন। এখন টাকা-জমি কোনোটাই দিচ্ছেন না। জমি অন্য কোথাও বিক্রি করতে দিচ্ছেন না। কেউ কিনতে চাইলে তাকে সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে হুমকি দেওয়া হয়। থানায় অভিযোগ করতে গেলেও নেয়নি। তার ভাই এসপি, যে কারণে মামলা নিতে চায় না পুলিশ। এছাড়া একই গ্রামের মৃত শরফু কাজীরও ৩৮ শতাংশ জমি দখলেরও অভিযোগ রয়েছে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। এদিকে, বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ হলেও চেয়ারম্যান প্রভাব খাটিয়ে ওই ঘের থেকে বালু উত্তোলন করে লাখ লাখ টাকা বিক্রি করেছেন। এতে ধসে গেছে পাশের সরকারি কালভার্ট, ভাঙছে ফসলি জমি।
চেয়ারম্যানের দাপটের কাছে অসহায় এলাকার মাঝি-মাল্লা সম্প্রদায়ও। তাদের অভিযোগ, খেয়াঘাট ইজারায় মাঝি-মাল্লাদের অগ্রাধিকার থাকলেও, ফুকরা খেয়াঘাট চেয়ারম্যান গোপনে তাঁর শ্বশুর জাকির মোল্লাকে ইজারা দিয়েছেন। মাঝি না হয়েও পর পর তিন বছর খেয়াঘাট ইজারা ভাগিয়ে নিয়েছেন তিনি। ঘাট ইজারা নিয়ে তিনি স্থানীয় মাঝিদের কাছে সাপ্তাহিক চুক্তিতে ইজারা দেন। ঘাট থেকে প্রতিদিন ২ থেকে ৩ হাজার টাকা টোল আদায় হয়। সে অনুযায়ী ঘাট থেকে বছরে প্রায় ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা টোল আদায় হয়। কিন্তু চেয়ারম্যান ঘাটটি ইউনিয়ন পরিষদের আওতায় রেখে রাজস্ব বঞ্চিত করছেন। এ বছর ঘাটটি মাত্র ১৮ হাজার টাকায় ইজারা হয়েছে। চেয়ারম্যানের স্বজনপ্রীতির কারণে স্থানীয় মাঝি-মাল্লাদের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। চেয়ারম্যানের ভয়ে কিছুই বলতে পারেন না তারা।
অভিযোগ রয়েছে, ইউপি চেয়ারম্যান পটু নিজ ইউনিয়নে মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত। তিনি নিজেও একজন মাদকাসক্ত। পুলিশ জেনেও পুলিশের বড় কর্মকর্তার ভাই হওয়ায় তাঁকে ধরতে সাহস পায়নি। উল্টো এলাকার কোনো মাদক ব্যবসায়ী ধরা পড়লে ছাড়িয়ে এনেছেন চেয়ারম্যান।
২০২২ সালের ২৪ ডিসেম্বর উপজেলার ফুকরা বাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে চেয়ারম্যানের সহযোগি হাদিস শিকদারকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন ও গুলিসহ গ্রেফতার করে র্যাব-৬। জামিনে বেরিয়ে চেয়ারম্যানের দেহরক্ষী হিসেবে এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। এতে আতঙ্কে রয়েছে এলাকার সাধারণ মানুষ।
ভূক্তভোগীর অভিযোগে জানা গেছে, ২০২২ সালে উপজেলার তারাইল বাজারে একই গ্রামের বাসিন্দা কাজী সাকির দোকানঘরের কাজ সংস্কার করছিলেন। চেয়ারম্যান পটু তার কাছে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা না পেয়ে চেয়ারম্যানের সন্ত্রাসী বাহিনী ভূমি অফিসের সামনে সাকিরকে বেধড়ক কুপিয়ে ও পিটিয়ে আহত করে। থানায় মামলা করতে গেলে নেয়নি পুলিশ। পরে আদালতে মামলা করলেও আজও বিচার পায়নি।
একই বাজারের মুদিমাল ব্যবসায়ী মাহাবুল মোল্যা চেয়ারম্যানকে সিগারেট বাকি না দেওয়ায় তাকে মারধর করে বাজার থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। মাসখানেক আগে ‘স্বামী-স্ত্রী কলহের’ অভিযোগে একই বাজারের হিন্দু ব্যবসায়ী অনুপকে চেয়ারম্যান নির্জন কক্ষে নিয়ে নির্যাতন করেন। স্থানীয় সূত্র জানায়, ওই বাজারের অধিকাংশ ব্যবসায়ী সংখ্যালঘু। তারা সব সময় চেয়ারম্যান ও তার বাহিনীর ভয়ে আতঙ্কে থাকেন। বাকি না দিলেই নেমে আসে অত্যাচারের খড়গ।
সাফলীডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা গরু ব্যবসায়ী পল্টু সমাদ্দার পটুর নির্বাচন না করায় চেয়ারম্যানের ভাই রইচ ফকির ওই ব্যবসায়ীকে বেধড়ক মারপিট করে। পরে সালিশ বৈঠকে ৫০ হাজার টাকা জরিমাণা করা হয়। তবে এখন পর্যন্ত জরিমাণার টাকা পায়নি ওই ভূক্তভোগী।
ভূক্তভোগীদের অভিযোগ, বড় ভাই এসপি শাহ ইফতেখার আহমেদের ছত্রছায়ায় শত অপকর্ম করলেও চেয়ারম্যান পটুর বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কাশিয়ানী থানায় কোনো অভিযোগ ও মামলা হয়নি। আদালতে মামলা করেও বিচার পায়নি তারা। পুলিশ ও তার সন্ত্রাসী বাহিনীর ভয়ে এলাকার কেউ তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায় না।
এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ইউপি চেয়ারম্যান শাহ ইশতিয়াক পটু বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ আনা হয়েছে, তা সত্য নয়। আমি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছি। আমি মাদক, চাঁদাবাজি, হামলা-মামলা কোন অপকর্মের সাথে জড়িত নই।’