,

এতিমখানায় ভুয়া এতিম শিশু!

জেলা প্রতিনিধি, কুড়িগ্রাম: কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার সমশের আলী শিশু সদনে কাগজে-কলমে মোট এতিম শিশু ১১০ জন। এর মধ্যে ৫০ শিশুর জন্য সরকারি তহবিল থেকে বছরে বরাদ্দ দেয়া হয় ১২ লাখ টাকা। অথচ কাগজে-কলমে সরকারি সুবিধাপ্রাপ্ত শিশুর সংখ্যা ৩৫। আর খোঁজ নিয়ে এই শিশু সদনে ১৫ শিশুর দেখা পাওয়া যায়।

পূর্ব সাপখাওয়া আজিজিয়া হাফেজিয়া লিল্লাহ বোর্ডিং ও এতিমখানায় ১৩০ জনের বিপরীতে খোঁজ নিয়ে শিশু পাওয়া যায় ৫৫।

কুড়িগ্রাম জেলায় এভাবে বাড়তি এতিম ও দুস্থ শিশু দেখিয়ে একটি চক্র অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। একাধিক মাদ্রাসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা স্বীকার করেন, কিছু ‘প্রক্সি’ নিবাসী শিশু রাখা হয়। এরা মাদ্রাসায় থাকে না। সমাজসেবা অধিদপ্তরের লোক পরিদর্শনে এলে এরা নিয়মিত শিশু হিসেবে হাজিরা দেয়। এ ধরনের অনিয়মে অধিদপ্তরের স্থানীয় পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও যোগ আছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।

জেলার আট উপজেলায় নিবন্ধিত ২১টি বেসরকারি এতিমখানায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২ হাজার ৭২। এর মধ্যে সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাওয়া শিক্ষার্থী ৯২৬। এসব এতিম শিশুর জন্য চিকিৎসা, খাওয়া এবং পোশাক বাবদ প্রতি মাসে জনপ্রতি ২ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকে। এর মধ্যে খাদ্য বাবদ ১ হাজর ৬০০ টাকা, পোশাকে ২০০ টাকা, ওষুধ ও অন্যান্য খাতে ২০০ টাকা ব্যয় করার শর্ত রয়েছে।

এদিকে জেলার সরকারি একটি এতিমখানার ৫৫ শিশুর জন্য মাসে জনপ্রতি ৪ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে জেলায় ৯৮১ এতিম শিশুর জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় ২ কোটি ৪৮ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। বিধি মোতাবেক এতিমখানায় ৬ থেকে ১৮ বছরের নিবাসী এতিম শিশু থাকতে হবে ন্যূনতম ১০ জন। শতভাগ নিবাসী প্রাথমিক-মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত করা সাপেক্ষে শতকরা ৫০ ভাগ শিশু এ সেবার আওতায় আসবে।

তবে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, এ ব্যাপারে সরকারি নিয়মনীতি মানছেন না শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা। এতিমদের খাবারের বরাদ্দকৃত টাকা শিক্ষক, ম্যানেজিং কমিটি এবং সমাজসেবা অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ভাগবাটোয়ারা করে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী যেসব শর্তে বরাদ্দ আসে, সেগুলো পূরণ করা হয় না বেশির ভাগ এতিমখানায়।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, রৌমারী উপজেলার টাপুরচর দারুল উলুম এতিমখানা ও হাফিজিয়া মাদ্রাসায় ১৮০ জন নিবাসী এতিম শিশুর মধ্যে ১০০ শিশুর জন্য ২২ লাখ ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দ হলেও সেখানে উপস্থিত শিশু ১৫ জন। আবার এই প্রতিষ্ঠানে কোনো এতিম শিশু নেই।

বায়তুল ক্বারার গোলাম হাবিব শিশু সদনে নিবাসী ১৫০ শিশুর মধ্যে ৭০ জনের জন্য ১৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ হলেও উপস্থিত শিশু রয়েছে ২৫।

উলিপুর উপজেলার জুম্মাহাট হাফিজিয়া কারিয়ানা মাদ্রাসা আদর্শ এতিমখানাতেও একই চিত্র। এখানে ৮৬ নিবাসী শিশুর মধ্যে ৫৪ জনের জন্য ১২ লাখ ২৪ হাজার টাকা বরাদ্দ এলেও উপস্থিত পাওয়া যায় ৩০-৩৫ শিশু।

ঠুটা পাইকর ইদ্রিসিয়া জামানিয়া শিশু সদনে ৭০ নিবাসী শিশুর মধ্যে ৩৫ জন সরকারি সুবিধা পায়। বজরা হোসাইনিয়া শিশু সদনে ৯০ শিশুর মধ্যে ৩০ শিশু এবং সাতঘড়ি নুরানী হাফিজিয়া মাদ্রাসায় নিবাসী ১০০ শিশুর মধ্যে ৫০ শিশুর জন্য সরকারি বরাদ্দ পাওয়া যায়।

একইভাবে চিলমারী উপজেলায় গোলাম হাবীব শিশু সদনে ৬৬ জনের বিপরীতে ৩০ জন এবং থানাহাট হাফিজিয়া আদর্শ ইসলামিয়া শিশু সদনে ৭২ জনের বিপরীতে ৫৬ জনের জন্য আসে সরকারি বরাদ্দ।

রাজারহাট উপজেলায় সিরাজী এতিমখানায় ৩০ শিশুর বিপরীতে ১৫ শিশু, বরকতিয়া ইসলামিয়া বালিকা শিশু সদনে ৭৮ শিশুর বিপরীতে ৩৫ জনের বরাদ্দ পাওয়া যায়।

ফুলবাড়ী উপজেলায় আব্দুল আজিজ সরকার ও সামিয়া আজিজ এতিমখানায় ৬০ শিশুর বিপরীতে ৩০ শিশু, মরহুম ডা. নজির হোসেন খন্দকার এতিমখানায় ৮৫ শিশুর বিপরীতে ২৬ শিশু, খড়িবাড়ি ফাতেমা এতিমখানায় ৬৩ শিশুর বিপরীতে ৪০ শিশু, দাশিয়ারছড়া কালিরহাট এতিমখানায় ৭০ শিশুর বিপরীতে ৩০ শিশু পায় সরকারি বরাদ্দ।

ভুরুঙ্গামারী উপজেলায় মোহাম্মদিয়া আল আবিব আল ফজরিয়া এতিমখানায় ৮০ শিশুর বিপরীতে ৪০ শিশু এবং কুড়িগ্রাম সদরের এছহাকিয়া শিশু সদনে ৩০০ শিশুর বিপরীতে ৪০ শিশু, ইউসিডি মহিউচ্ছুন্নৎ নাছিরিয়া এতিমখানায় ১০০ শিশুর বিপরীতে ৬০ শিশু সরকারের দেয়া বরাদ্দের সুযোগ-সুবিধার তালিকাভুক্ত।

কাগজে-কলমে এসব শিশুর উল্লেখ থাকলেও সরেজমিন খোঁজ নিয়ে বাস্তবের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া জেলার একমাত্র সরকারি শিশু পরিবারে (বালক) ১০০ শিশুর বিপরীতে ৫৫ শিশু সরকারি বরাদ্দ পায়।

সমশের আলী শিশু সদনে এক শিক্ষার্থী বলে, ‘আমাদের এখানে ৩৫ ছাত্র থাকি। তবে ১৫ জন রাতে থাকে ও খায়। ভাত, ডাল, আলু ভর্তা, সবজি সকাল-রাতে এবং ব্রয়লার মুরগির গোশত, পাঙাশ মাছ, ডিম মাঝেমধ্যে দুপুরে খেতে দেয়।’

এই এতিমখানার সাধারণ সম্পাদক খবির উদ্দিন আহমেদ স্বীকার করেন, তাদের এতিমখানায় ৫০ শিশুর বরাদ্দ আসে। তবে নিয়মিত ৩৫ এতিম শিশু খাওয়ানো হয়।

জুম্মাহাট হাফিজিয়া কারিয়ানা মাদ্রাসা আদর্শ এতিমখানার এক ছাত্র বলে, ‘গোশত, ডিম, সবজি খেতে দেয়। তবে এই এতিমখানায় নিয়মিত ৩০-৩৫ শিশু থাকে এবং খায়।’

এই এতিমখানার কমিটির সাবেক সদস্য আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘তছরুপের পদ্ধতিটা হলো এতিমখানায় কিছু ভাড়াটে ছাত্র আছে। এদের সমাজসেবা কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। পরিদর্শনে আসার আগে খবর দিয়ে আসে। সে সময় এই ভাড়াটে ছাত্রদের দেখানো হয়। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, বর্তমান যারা আছে, তাদের মধ্যে ১২-১৩ জনের বেশি এতিম নেই এখানে।’

বায়তুল ক্বারার গোলাম হাবিব শিশু সদনের এক ছাত্র বলে, ‘আমাদের এখানে ২৫ জন শিশুর খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হয়। এতিমখানা থেকে বছরে দুবার পাঞ্জাবি ও পায়জামা দেয়।’

টাপুরচর দারুল উলুম এতিমখানা ও হাফিজিয়া মাদ্রাসায় কয়েকজন শিশু নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলে, তাদের এতিমখানায় ৩০-৩৫ শিশু আছে। এখানে কেউ এতিম নেই। সবারই বাবা-মা আছে। এ ছাড়া এই এতিমখানার শিশুদের দিয়ে গ্রামে গ্রামে চাঁদা তোলা হয়। চাল, টাকা ইত্যাদি তুলে এতিমখানায় দেয়া হয়। তাই দিয়ে এতিমখানা চলে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি মাদ্রাসার শিক্ষক বলেন, ‘এতিম শিশু না থাকলেও সমাজসেবা কর্মকর্তাকে প্রতি বিলের সময় ৪০-৫০ হাজার টাকা দিতে হয়। তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ট্রেজারিসহ সবকিছু সমন্বয় করেন। এভাবেই চলছে। এতিম শিশু না থাকলেও থাকা, খাওয়া এবং কমিটি, শিক্ষকসহ বাকি টাকা খরচ হয়ে যায়।’

কুড়িগ্রাম সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক রোকোনুল ইসলাম অনিয়মের কথা স্বীকার করে বলেন, ‘ফুলবাড়ী, নাগেশ্বরী, উলিপুর, চিলমারী, সদরসহ বেশ কয়েকটি এতিমখানায় অনিয়ম আছে। তার ওপরেও এতিম শিশু ৮-১০টি করে বেশি দেখানোর চাপ রয়েছে।’

এই বিভাগের আরও খবর