বিডিনিউজ ১০ ডেস্ক: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়যুক্ত করায় ভোটার, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সর্বস্তরের জনগণকে ধন্যবাদ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের ভোটের মর্যাদা রক্ষা করে তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনে আমি আমার বুকের রক্ত দিতেও প্রস্তুত। আমি সেই ওয়াদাই আজকে করে যেতে চাই। আমি এটুকুই বলব, দেশের মানুষ যে বিশ্বাস রেখেছে তার মর্যাদা আমি আমার জীবন দিয়ে হলেও রক্ষা করে যাব।’ গতকাল শনিবার বিকেলে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের ‘বিজয় সমাবেশ’-এ সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল বিজয় উদ্যাপন করতে ওই সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
গতকাল বিকেল ৩টা ৫ মিনিটে শেখ হাসিনা সমাবেশস্থলে উপস্থিত হন। এরপর সমাবেশে প্রায় দেড় ঘণ্টা বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। শেখ হাসিনা বিকেল ৪টা ৩৭ মিনিটে বক্তব্য শুরু করেন। প্রায় ২০ মিনিটের বক্তব্যে শেখ হাসিনা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানান। টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া শেখ হাসিনা তাঁর বক্তব্যে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেননি, করেননি কোনো সমালোচনাও। বরং দল-মত-নির্বিশেষে সবাইকে দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানান।
নির্বাচনে নিজেদের বিপুল বিজয় প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগপ্রধান বলেন, ‘এ বিজয় শুধু আওয়ামী লীগের নয়, এ বিজয় স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তির, এ দেশের আপামর জনগণের।’ তিনি বলেন, ‘ঐক্যবদ্ধ শক্তি যে সব সময় বিজয় অর্জন করে, এই নির্বাচনে সেটাই আবার প্রমাণিত হয়েছে। যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে, সব রাজনৈতিক দলকে আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি যে তারা এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নির্বাচনকে অর্থবহ করেছে। জয়-পরাজয় একটা নির্বাচনে স্বাভাবিক ব্যাপার। আমি তাদের এটুকু বলতে চাই যে আওয়ামী লীগ নৌকা মার্কায় ভোট পেয়ে জয় পেয়েছে, এটা সত্য; কিন্তু যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে এসেছে, যখন দায়িত্ব পেয়েছি জনগণের সেবা করার, যখন সুযোগ পেয়েছি মানুষের জন্য কাজ করার তখন আমি এটা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে পারি, দল-মত-নির্বিশেষে সবার জন্যই আমাদের সরকার কাজ করে যাবে। প্রত্যেকের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করবে। রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করবে। প্রত্যেক মানুষের উন্নয়নে কাজ করবে। সেখানে কোনো দল-মত দেখা হবে না। প্রত্যেক নাগরিক আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সেবা করার দায়িত্ব জনগণ আমাদের দিয়েছে। কাজেই যারা ভোট দিয়েছে আর যারা ভোট দেয়নি সবার প্রতিই আমি ধন্যবাদ জানিয়ে এটুকু বলব, আমরা সকলের তরে, সকলের জন্য। সকলের জন্যই আমরা কাজ করব।’
মাদকের বিরুদ্ধে রায়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে রায় : শেখ হাসিনা বলেন, ‘জনগণ যে স্বতঃস্ফূর্ত ভোট দিয়েছে, সেই ভোটের সম্মান যেন থাকে, অবশ্যই আমরা সেই বিষয়টা সব সময় মাথায় রেখে সার্বিকভাবে সুষম উন্নয়ন করে যাব দেশের জনগণের স্বার্থে। যে রায় জনগণ দিয়েছে এ রায় হলো জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে রায়, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রায়, মাদকের বিরুদ্ধে রায়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে রায়। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে। নির্বাচিত প্রতিনিধি যারা, দেশের মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা তা পূরণ করা আমাদের কর্তব্য। বিজয় পাওয়া যত কঠিন, সেই বিজয় রক্ষা করে জনগণের সেবা করা সেটা আরো কঠিন কাজ। সেই কঠিন দায়িত্ব আমরা পেয়েছি, সেই দায়িত্ব আমাদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে পালন করতে হবে। সেটাই আমি সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই।’
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘জনগণ রায় দিয়েছে শান্তি এবং উন্নয়নের পক্ষে। তারা শান্তি চায়, তারা উন্নয়ন চায়, বাংলাদেশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাক তারা তা চায়। আমাদের ওয়াদা বাংলাদেশকে আমরা ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে তুলব। ৩০ ডিসেম্বরের এই রায়, বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত করে গড়ে তোলার রায়।…জনগণের রায় হচ্ছে আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার রায়। এ রায় হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি রায়। কারণ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি এবারের জনগণ রায় দিয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। বাংলার মাটিতে স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী তাদের কোনো স্থান হবে না। দুর্নীতিবাজ, মাদকাসক্তদের স্থান হবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য দেশের মানুষ রায় দিয়েছে। আমরা এই দেশকে উন্নত, সমৃদ্ধ, সোনার বাংলাদেশ হিসেবে ইনশাআল্লাহ গড়ে তুলব। এটাই হচ্ছে আমাদের অঙ্গীকার। আমরা যে অঙ্গীকার করেছি সে অঙ্গীকার আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশের জনগণ আমাকে তাদের সেবা করার সুযোগ দিয়েছে।…আমি আমার জীবনকে উৎসর্গ করেছি। ব্যক্তিগত জীবনে কোনো চাওয়া-পাওয়া আমার নেই। স্বজন হারানোর সেই বেদনা নিয়েও এই বাংলাদেশকে গড়ে তুলব। ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত সোনার বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশে একটি মানুষও গরিব থাকবে না, গৃহহীন থাকবে না।…আগামী দিনে বাংলাদেশ হবে উন্নত, সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ, এটাই আমাদের প্রতিজ্ঞা, এটাই আমাদের লক্ষ্য। আর এটা করতে হলে দেশ থেকে যেমন দুর্নীতি দূর করতে হবে, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে মাদকমুক্ত, সন্ত্রাসমুক্ত দেশ আমাদের গড়তে হবে। মানুষের শান্তি নিশ্চিত করতে হবে।’
সরকার পরিচালনায় সহযোগিতা চেয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি সহযোগিতা চাই দেশের মানুষের কাছে, আমি সহযোগিতা চাই আমাদের ছাত্র-শিক্ষক থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে। আসুন, আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাংলাদেশকে গড়ে তুলি। আমাদের বর্তমানকে উৎসর্গ করি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, যেন তারা একটা সুন্দর সমাজ পায়, মাথা উঁচু করে যেন বিশ্বের বুকে চলতে পারে। আমরা সেভাবেই দেশকে গড়ে তুলতে চাই। তার জন্য যা যা করার প্রয়োজন আমরা করব। আমাদের প্রতিটি গ্রামের মানুষ পাবে শহরের সব নাগরিক সুবিধা। সেভাবে আমরা তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের জীবনকে উন্নত করব। শিক্ষার আলো প্রতিটি ঘরে যেন পৌঁছে সেভাবে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, “এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, যেখানে দাঁড়িয়ে জাতির পিতা ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এখানে দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ পঁচাত্তরের পর দাবায়ে রাখার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু আজকে প্রমাণিত হয়েছে বাংলার মানুষকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না, পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না। কারো কাছে মাথা নত নয়, বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে বাঙালি চলবে।”
বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে সুকান্ত ভট্টাচার্যের ছাড়পত্র কবিতা থেকে কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করেন প্রধানমন্ত্রী। শেষে তিনি বলেন, ‘আসুন আমরা প্রতিজ্ঞা করি, যেকোনো ত্যাগের বিনিময়ে জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ আমরা গড়বই, ইনশাআল্লাহ।’
সমাবেশে শেখ হাসিনা বক্তব্য শুরু করার আগে তাঁর উদ্দেশে একটি অভিনন্দনপত্র পাঠ করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। পরে ওবায়দুল কাদের অভিনন্দনপত্রটি শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেন। সমাবেশে আরো বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদ, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী ও মোহাম্মদ নাসিম, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আবদুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী প্রমুখ। সমাবেশ পরিচালনা করেন আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ ও উপপ্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন।
বর্ণাঢ্য সাজ : গতকাল সকাল থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ও আশপাশের জেলাগুলো থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে যেতে থাকে। মানুষের এ স্রোত ছিল বর্ণিল সাজে সজ্জিত। কোনো এলাকার নেতাকর্মীরা উপস্থিত হয়েছে লাল-সবুজ টি-শার্ট পরে, কোনো এলাকার নেতাকর্মীরা হলুদ বা লাল টুপি মাথায় দিয়ে। ছোট-বড় ট্রাকে চড়ে সাউন্ড বক্সে গান বাজিয়ে সমাবেশে যোগ দেয় অনেক নেতাকর্মী। হাতিতে চড়ে, ব্যান্ড পার্টিসহ নানা বাদ্যযন্ত্র নিয়ে যোগ দিতে দেখা যায় কয়েকটি মিছিল। মিছিলে আগত অনেকের হাতেই বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি ছিল। জাতীয় ও দলীয় পতাকাও বহন করে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী।
গতকাল সকাল ১০টার আগে থেকেই আওয়ামী লীগ এবং এর বিভিন্ন সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে এগোতে শুরু করে। মিছিল ও সমাবেশে ছিল উৎসবের আমেজ। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে নেতাকর্মীরা চারদিক প্রকম্পিত করে। ‘জিতল আবার নৌকা’ গানটি ভেসে আসতে থাকে বিভিন্ন ট্রাক, পিকআপ থেকে। নেচে-গেয়ে তরুণ নেতাকর্মীরা সমাবেশে যোগ দেয়।
সমাবেশের মঞ্চ সাজানো হয় নৌকার আদলে। সমাবেশস্থলের আশপাশে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি এবং বেলুন, প্ল্যাকার্ড দিয়ে সাজানো হয়। প্রবেশপথগুলোও সাজানো ছিল বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার ছবি এবং বিগত ১০ বছরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের নানা অর্জনের তথ্য দিয়ে।
গানে মাতল পুরো সমাবেশ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমাবেশস্থলে উপস্থিত হওয়ার পর দুটি গান পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী ও সংসদ সদস্য মমতাজ বেগম। ‘সব নেতার চাইতে আমার শেখ হাসিনাই ভালা’ গানটির তালে তালে দুলে ওঠে পুরো সমাবেশ। প্রধানমন্ত্রীও দুই হাতে তালি দিয়ে তাল মেলান। মঞ্চের সামনের দিকে উপস্থিত নারীরা গানের তালে নাচে।
এর আগে মঞ্চে সংগীত পরিবেশন করেন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী রফিকুল আলম, ফকির আলমগীর, জানে আলম, পথিক নবী, আঁখি আলমগীর ও সালমা। জনপ্রিয় ব্যান্ডদল জলের গান মঞ্চে গান গেয়ে শোনায়। ওই সময় পুরো সমাবেশস্থল গানের তালে মেতে ওঠে। বিভিন্ন শিল্পীর গানে ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বন্দনা। টানা দুই মেয়াদে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের নানা অর্জনের কথাও উঠে আসে কারো কারো গানে।