বিডিনিউজ ১০, আর্ন্তজাতিক ডেস্ক: অধিকৃত পশ্চিমতীরে পা রাখার পরের দিন পূর্ব জেরুজালেম-সংযুক্ত আল-আকসা মসজিদে গিয়ে ফিলিস্তিনিদের ক্ষোভ জাগিয়ে তুলেছেন সৌদি প্রতিনিধিরা।
রামাল্লায় মঙ্গলবার সৌদি ফুটবল দলের সঙ্গে একটি ম্যাচ খেলবেন ফিলিস্তিনিরা। ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপ ও পরের বছরের এশিয়া কাপের বাছাইপর্বের এই ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হবে শহরটিতে।-খবর মিডল ইস্ট আইয়ের
এর মধ্যে দিয়ে সৌদি প্রতিনিধিরা প্রথমবারের মতো অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে প্রবেশ করলেন। ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা ও সাদা পোশাকের নিরাপত্তা কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে সৌদি টিম ব্যবস্থাপনার ১৩ সদস্য সোমবার আল-আকসা পরিদর্শন করেন।
ইসলামের অন্যতম এই পবিত্র স্থানটিতে তাদের সফরের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছেন ফিলিস্তিনি মুসল্লিরা। এসময় সৌদি প্রতিনিধিদের কাছ থেকে মুসল্লিদের দূরে সরিয়ে রাখে নিরাপত্তা কর্মীরা। সৌদিদের সঙ্গে মুসল্লিদের আলাপ করতেও দেয়া হয়নি।
স্থানীয় গণমাধ্যমের খবর বলছে, এই সফরের সময় আল-আকসা থেকে তিন ফিলিস্তিনিকে আটক করে দখলদার ইসরাইলি বাহিনী।
মূলত আল-আকসার প্রবেশাধিকারের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল করে গড়ে ওঠা এই অবৈধ রাষ্ট্রটি।
রোববার ১০০ সৌদি প্রতিনিধি রামাল্লায় পৌঁছান। জর্ডান ও অধিকৃত পশ্চিমতীরের মধ্যে একমাত্র সীমান্ত আলানবি সেতু নামে পরিচিত কারামা ক্রোসিং হয়ে প্রথমবারের মতো কোনো সৌদি প্রতিনিধি দল ফিলিস্তিনে গেল।
আর্থিক সংকটে থাকা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে দীর্ঘদিন থেকে সহায়তা করে আসছে সৌদি আরব। কাজেই সৌদি অতিথিদের জন্য ব্যাপক রাজনৈতিক অভ্যর্থনার আয়োজন করেন ফিলিস্তিনি প্রেসিড্ন্টে মাহমুদ আব্বাস।
পশ্চিমতীরে ঢুকতে হলে জর্ডানের সঙ্গে ক্রোসিংটি পার হতে হবে। আর সেটির নিয়ন্ত্রণ করে ইসরাইল। কাজেই সৌদি প্রতিনিধি দল ইসরাইলি বাহিনীর কঠোর তল্লাশির পরেই ঢুকতে পেরেছে ফিলিস্তিনে।
স্বাগত বক্তব্যে মাহমুদ আব্বাস বলেন, বিলম্ব ও কিছুটা বাধার মুখোমুখি হওয়ায় আমার দুঃখ প্রকাশ করছি। আমাদের ফিলিস্তিনিদের প্রতিনিয়ত এমন বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছে। কিন্তু তারপরেও এর একটা মূল্য আছে। আপনারা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ফিলিস্তিনি ভাইদের মাঝে এসেছেন, এটা গুরুত্বপূর্ণ।
ইসরাইলের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্কের উষ্ণতা বাড়ছে। ফিলিস্তিনিদের প্রতিও উপসাগরীয় দেশটির সমর্থনে ভাটা পড়েছে।
আর ইসরাইলি সমর্থন ছাড়া এই সফর অসম্ভব ছিল। মূলত ইহুদিবাদী রাষ্ট্রটির মৌন সম্মতি নিয়েই ফিলিস্তিনে আসলেন সৌদিরা।
ইসরাইলকে বর্জনে যেসব ক্ষেত্রে আরবদের ঐক্যমত রয়েছে, সেসবকে তুচ্ছ করেই সৌদিরা এই সফরে বলে মনে করেন অধিকাংশ ফিলিস্তিনি। এতে রিয়াদের সঙ্গে তেলআবিবের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের দিকে যাচ্ছে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।
ইহুদিদের একটি উৎসবের সময় সৌদিরা আল-আকসা পরিদর্শনে যান। এ সময়ে মসজিদটিতে ফিলিস্তিনিদের প্রবেশ সীমিত করে দেয় ইসরাইলি বাহিনী।
ইসরাইল ও জর্ডানের মধ্যে সই হওয়া চুক্তির লঙ্ঘন করে ইহুদি দখলদারদের প্রার্থনার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে।
সৌদিদের এই সফরকে নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। ফিলিস্তিনে যেতে হলে সব ধরনের ভিসা আবেদনের ক্ষেত্রে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের চূড়ান্ত অনুমোদন দরকার পড়ে। তার অর্থ দাঁড়ায়, পশ্চিমতীরে ঢুকতে সৌদিদের পরোক্ষভাবে সবুজ সংকেত দিয়েছে ইসরাইল।
ফিলিস্তিনি ফুটবল ফেডারেশনের প্রধান ও ফিলিস্তিনি প্রতিরোধী নিরাপত্তা বাহিনীর সাবেক প্রধান জিবরাঈল রাজৌব বলেন, আমাদের ফুটবলের ইতিহাসে এই সফর নজিরবিহীন। রাজনৈতিকভাবে আমাদের সংকট ও বিপ্লব শুরু হওয়ার পর থেকে সৌদি আরবের নীতি ও বিনিয়োগের অবিরাম চেষ্টার সর্বোচ্চ পর্যায় হচ্ছে এই ম্যাচটি।
কিন্তু সৌদি প্রতিনিধিদের আগমনকে যখন ফিলিস্তিনিদের জন্য সুখের বলে আখ্যায়িত করেন প্রেসিডেন্ট আব্বাস, তখন অনেক ফিলিস্তিনি মনে করেন, এই সফর সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক। ইসরাইল ও আরব দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের নতুন অধ্যায় হয়ে থাকবে।
এর আগে ২০১৮ সালের বিশ্বকাপ ও ২০১৯ সালের এশিয়া কাপের বাছাইপর্বের জন্য জেরুজালেমে ফিলিস্তিনি জাতীয়দলের সঙ্গে একটি ম্যাচ খেলার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে সৌদি ফুটবল ফেডারেশন। এটা ২০১৫ সালের ঘটনা। ইসরাইলকে বর্জনে আরব লীগের বাধ্যবাধকতা থেকেই রিয়াদকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল।
পরবর্তী সৌদি আরবের নীতিতে অনেক বদল ঘটেছে। ইসরাইল ও ফিলিস্তিনিদের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিতর্কিত ‘শতাব্দির চুক্তিতে’ সমর্থন জানিয়েছে রিয়াদ।
যদিও ইসরাইলের অনুকূলে জোরালো পক্ষপাতমূলক হওয়ায় ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক সংগঠনগুলো প্রত্যাখ্যান করেছে চুক্তিটি। ট্রাম্প প্রশাসন প্রণীত ওই চুক্তিতে ফিলিস্তিনিদের সার্বভৌমত্বের কোনো নিশ্চয়তা দেয়া হয়নি।
এক বিবৃতিতে ফিলিস্তিনের বর্জন, পরিত্যাগ ও নিষেধাজ্ঞা জাতীয় কমিটি (বিএনসি) বলছে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ভিসা আবেদন করায় সৌদি ফুটবল দলের সফর ইসরাইলকে বর্জনের নীতি পুরোপুরি লঙ্ঘন করেনি।
কিন্তু তা সত্ত্বেও সংস্থাটির দাবি, প্রত্যাখ্যানের চার বছরের মাথায় অধিকৃত ভূখণ্ডে সৌদিদের এ সফর খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এমন এক সময় তারা এই সফরে এসেছেন, যখন বেশ কয়েকটি আরব দেশের সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের দিকে যাচ্ছে।
অধিকৃত ভূখণ্ডে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনভাবে চলাচল করতে দেয় না দখলদার ইসরাইল। ব্যাপক বাধা ও বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে দিন পার করতে হচ্ছে তাদের। ঠিক এমন এক সময়ে সৌদি প্রতিনিধিরা পশ্চিমতীর সফরে গেলেন।
সেদিকে ইঙ্গিত করে ফিলিস্তিনি ক্রীড়া সাংবাদিক আহমেদ আবু দিয়াব বললেন, পশ্চিমতীরভিত্তিক ফিলিস্তিনি জাতীয় দলে গাজার কোনো খেলোয়াড় নেই। ১৯৯৯ সালে যেখানে অবরুদ্ধ উপত্যকাটির ১১ খেলোয়াড় ছিলেন।
২০০৭ সাল থেকে গাজা ভূখণ্ডকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে ইসরাইল। এতে পশ্চিমতীর ও গাজার খেলোয়াড়রা পরস্পরের ভূখণ্ডে চলাচল করতে পারেন না। কিন্তু সৌদি ফুটবল দল সহজেই ইসরাইলের অনুমোদন পাওয়ায় বহু রাজনৈতিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
এই ক্রীড়া সাংবাদিক বলেন, গাজায় একটি স্টেডিয়াম হতে পারে এবং ইসরাইলের অনুমোদন ছাড়াই সেখানে আরব প্রতিনিধিদের যাওয়া সুযোগ করে দেয়া যায়। মিসরের সঙ্গে গাজার একটি সীমান্ত রয়েছে। যেখানে ইসরাইলের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
ইসরাইলের সঙ্গে আরবদের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ নিয়ে ফিলিস্তিনি তরুণরা সম্প্রতি একটি প্রচারে নেমেছেন। সৌদি খেলোয়াড়দের এই সফরের বিরোধিতা করেই তারাও অনলাইনে ট্রল করছেন।
মাহমুদ হামদান নামের এক তরুণ বলেন, এ সফরের মধ্যে ইসরাইলের দখলদারিত্বে সৌদির মৌন সমর্থন দেখছেন তিনি।
২০১৫ সাল থেকে ইয়েমেনে ধ্বংসাত্মক বিমান হামলা চালিয়ে আসছে সৌদি। সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ব্যাপক সমালোচনার মুখে নিজের ভাবমর্যাদাকে পরিমার্জন করতে চাচ্ছে রিয়াদ।
মাহমুদ হামদান বলেন, সৌদি আরবে বড় একটা সংখ্যক ফিলিস্তিনি আটক রয়েছেন। কাজেই সৌদি দলের এই সফর নিয়ে ফিলিস্তিনিরা সচেতন। এটাকে ইসরাইলের সঙ্গে আরবদের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের আভাস হিসেবেই দেখছেন তারা। এক্ষেত্রে খেলাধুলাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা সহজ।
কারণ সাধারণত খেলার মধ্যে কোনো রাজনৈতিক যোগসাজশ খুঁজে দেখা হয় না বলে মন্তব্য এই ফিলিস্তিনি তরুণের।