,

আলো ছড়াচ্ছে মতিনের পরিবেশ স্কুল

জেলা প্রতিনিধি, কুমিল্লা: গ্রামের মাঝ দিয়ে চলে গেছে পাকা রাস্তা। আশপাশজুড়ে প্লাবনভূমি। সেখানে পানিতে দাপাদাপি করে মাছেরা। শিকারের লোভে প্লাবনভূমিতে নানা পাখিরও আনাগোনা। কুমিল্লার দাউদকান্দির পুটিয়ায় এমন নৈসর্গিক গ্রাম আদমপুরে গড়ে উঠেছে দেশের প্রথম পরিবেশ স্কুল। ভিন্নধর্মী এই স্কুলটির উদ্যোক্তা কৃষি ও পরিবেশবিদ মতিন সৈকত।

২০২১ সালে তিন কক্ষবিশিষ্ট স্কুলটি স্থাপন করেন এই পরিবেশবিদ। পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ, জলবায়ু, কৃষি, নদী, সেচ, জীববৈচিত্র্য, নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক জনসচেতনতা এবং গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে স্কুলটি।

মতিন সৈকত বলেন, ‘আমি উদ্যোগটি শুরু করেছি মাত্র। এখন হাজার হাজার পরিবেশকর্মী তৈরি হয়েছে। স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে পরিবেশ স্কুলে বিভিন্ন ওরিয়েন্টেশন কর্মসূচি পালন করা হয়। অল্প দিনে স্কুলের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। ফাঁকা সময়ে এখানে কর্মসূচি পালন করা হয়। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে বেশিসংখ্যক কর্মসূচি পালন করা হয়। স্থানীয় সচেতন জনসাধারণ, শিক্ষক, সাংবাদিক ও জনপ্রতিনিধিসহ সবার প্রচেষ্টায় পরিবেশ ভালো রাখতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। পরিবেশ ভালো থাকলেই আমরা ভালো থাকব।’

তিনি বলেন, ‘স্কুল বলতে সাধারণত যা বোঝায় এটি তার ব্যতিক্রম। এখানে নিয়মিত শিক্ষার্থী বা শিক্ষক নেই। বেতন-ভাতা, পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। অনেকের জীবনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের সুযোগ থাকে না। আবার সবার পক্ষে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। তবে সবাই সামাজিকভাবে শিক্ষিত। সেই শিক্ষাটাই এ স্কুলে কাজে লাগানো হয়। আর তাতে ব্যাপক সাড়া জেগেছে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার শিক্ষক ও পরিবেশবিদরা স্কুলে বসে স্থানীয় মানুষ ও শিক্ষার্থীদের পরিবেশ বিষয়ক নানা টিপস দিয়ে থাকেন।’

দাউদকান্দির স্থানীয় সাংবাদিক মোহাম্মদ হানিফ বলেন, ‘স্কুলটির উদ্যোগ নেওয়া থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে মতিন সৈকতের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করেছি। পরিবেশ রক্ষায় এমন উদ্যোগ ব্যতিক্রম। দেশের জন্য এটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।’

শুধু স্কুল প্রতিষ্ঠা নয়, দাউদকান্দির আদমপুর গ্রামসহ এর প্রতিবেশী গ্রামগুলোয় বিষমুক্ত সবজি চাষেও অনবদ্য ভূমিকা রেখেছেন এই পরিবেশবিদ। এছাড়া জলাধারে আহত পাখিদের উদ্ধার ও চিকিৎসায় ভূমিকা রেখে চলেছেন তিনি।

দাউদকান্দির পুটিয়া সিসিডিএ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহফুজা বেগম বলেন, ‘মতিন সৈকত ছোটবেলা থেকেই নানারকম সেবামূলক কাজ করে আসছেন। তিনি আদমপুর আদর্শ কমপ্লেক্সের সভাপতি। তার অনেকগুলো সেবামূলক কাজের একটি হচ্ছে পরিবেশ স্কুল। তিনি প্রায়ই আমাদের ডেকে একসঙ্গে বসান। নানারকম সামাজিক বিষয়ে কথাবার্তা বলেন। শিশু-কিশোরদের নিয়ে ভালো ভালো কাজ করেন।’

১৯৯৭ সাল থেকে কৃষি, পরিবেশ ও সামাজিক উন্নয়নে মতিন সৈকত নিবেদিতপ্রাণ। ২০০৬ সাল থেকে পাখি উদ্ধার, পরিচর্যা এবং অবমুক্ত করে আসছেন তিনি। এখন পর্যন্ত মতিন সৈকত প্রায় ১ হাজার ৫০০ পাখি উদ্ধার করেছেন।

মতিন জানান, প্লাবনভূমিতে মাছ শিকারে পাখিদের বেশ আনাগোনা থাকে। এসব পাখি নানা কারণে আহত হয়। তাদের উদ্ধার করে চিকিৎসা দেন তিনি। এছাড়া অনেক বন্যপ্রাণী উদ্ধার এবং অবমুক্তও করেছেন মতিন।

স্থানীয়রা জানান, মতিন সৈকতের ৩০ বছরের প্রচেষ্টায় সরকার কালাডুমুর নদী পুনঃখনন করেছে। সড়ক-মহাসড়ক, শহর-নগরের ময়লা-আবর্জনা, বর্জ্য থেকে সিটিজেন ফার্টিলাইজার বা নাগরিক সার রূপান্তর কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য তিনি সরকার এবং উন্নয়ন সংস্থার কাছে জোর দাবি জানিয়ে আসছেন। মতিনের যৌথ উদ্যোগে সমৃদ্ধ এবং স্বনির্ভর হচ্ছে দাউদকান্দির মানুষ।

তারা জানান, নার্সারি স্থাপন এবং বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার পাশাপাশি পাখি ও বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য গড়ার জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টি করেন মতিন। বোরো ধান রোপণ থেকে পাকা ধান কাটা পর্যন্ত মৌসুমব্যাপী ৩০ বছর ধরে মাত্র ২০০ টাকার বিনিময়ে সেচ সুবিধা দিয়ে জাতীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। একটি শ্যালোমেশিনে দাউদকান্দির তিনটি গ্রাম আদমপুর, পুটিয়া ও সিংগুলার ১৫০ বিঘা জমিতে এ সেচ সুবিধা দেন মতিন। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি দুইবার বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক ও একবার জাতীয় পরিবেশ পদক পেয়েছেন।

স্থানীয় পরিবেশকর্মী ফায়সাল সাকির বলেন, ‘মতিন সৈকতের কাজে দেশপ্রেম ফুটে ওঠে। তাই নিজেও সুযোগ পেলে ওনার সঙ্গে পরিবেশ নিয়ে কাজ করি। আমি তার কাজের অংশীদার হতে পেরে ধন্য মনে করছি।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লার সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর মাসুম বলেন, ‘মতিন সৈকত শুধু একজন পরিবেশবিদই নন, তিনি শিক্ষকও বটে। সামাজিক ও পরিবেশ আন্দোলনে ভূমিকা রাখা এমন মানুষ দেশে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তার এমন ইতিবাচক কর্মকাণ্ডে দাউদকান্দির সাধারণ মানুষ শক্তি পায়। রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে এমন মানুষের খুব দরকার।’

দাউদকান্দির উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মঈনুল হাসান বলেন, ‘মতিন সৈকতের এ কাজটি সমাজের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে। পরিবেশ রক্ষায় ও স্কুলটিকে এগিয়ে নিতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যত ধরনের সহায়তা করা সম্ভব হয়, তার সবটুকু করতে আমরা প্রস্তুত আছি।’

এই বিভাগের আরও খবর