জেলা প্রতিনিধি, খুলনা: খুলনার উপকূলীয় অঞ্চল কয়রা উপজেলা ঘিরে রয়েছে কপোতাক্ষ, শাকবেড়িয়া, কয়রাসহ একাধিক নদ-নদী। উপকূলীয় অঞ্চল হওয়ায় বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষের নিকট ভয়াবহ আতঙ্কের আরেক নাম বেড়িবাঁধ।
ঘূর্ণিঝড় আইলা, ফণী, বুলবুল এবং সর্বশেষ গত বছর একই সময়ে সুপার সাইক্লোন আমফান ও ইয়াসে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয় উপকূলীয় অঞ্চল খুলনার কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল।
জানাযায়, গত বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলীয় কয়রা উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১৪টি পয়েন্টের বেড়িবাঁধ ভেঙে গোটা এলাকা লোনা পানির নিচে প্লাবিত হয়। বিধ্বস্ত হয় হাজার হাজার ঘরবাড়ি ,রাস্তাঘাট, গাছপালা, গবাদি পশু, মৎস্য ঘের ও জমির ফসল। সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায় বিস্তীর্ণ জনপদের হাজারো মানুষ। সর্বশেষ আমফান ও ইয়াসে ক্ষতিগ্রস্থ বাঁধ গুলোর সংস্কার কাজ বর্তমানে চলমান রয়েছে।
সরেজমিনে প্রতিবেদনকালে কয়রা উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ গুলোর মধ্যে সদর ইউনিয়নের মদিনাবাদ লঞ্চ ঘাট, মদিনাবাদ তফসিল অফিসের সামনে হতে হামকুড়ার গোড়া, মহারাজপুর ইউনিয়নের সুতির অফিস ও দশালিয়া, দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের ঝুঁকিপূর্ণ ওয়াপদা বাঁধ গাববুনিয়া, মাটিয়াভাঙ্গা (কোবাদক ফরেষ্ট অফিস থেকে ঘড়িলাল বাজার) আংটিহারা ( স্লুইস গেট থেকে পুলিশ ফাঁড়ি), পাতাখালি (খাশিটানা বাঁধ থেকে জোড়শিং বাজার)।
এ ছাড়াও উপজেলার কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদী-তীরবর্তী যেসব এলাকায় এখনও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়নি, ওইসব এলাকার সর্বসাধারণের মাঝে ঘুর্ণিঝড় ‘অশনি’ নিয়ে বর্তমানে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে ।
প্রতিবেদনকালে সরেজমিনে তারা পূর্বপশ্চিমবিডিকে জানান, তাদের অধিকাংশেরই নেই দুর্যোগ সহনশীল বাড়িঘর। ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও ইয়াসে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ২০ হাজার পরিবারের অনেকেই এখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেননি। এর মধ্যে আরেকটি দুর্যোগের সতর্ক সংকেত তাদেরকে ভাবিয়ে তুলছে।
তবে উপজেলা প্রশাসন ঘূর্ণিঝড় অশনি মোকাবেলায় ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন বলেও এ প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের জোড়াশিং গ্রামের কামাল হোসেন জানান, সুপার সাইক্লোন আইলায় নদী ভাঙনে তার বসত ঘরটি বিলীন হয়ে যায়। এরপর বহু কষ্টে নতুন করে ঘর নির্মাণ করলেও কয়েক মাসের মধ্যে নদী ভাঙনে সেটিও বিলীন হয়ে গেলে বাধ্য হয়ে তিনি বেঁচে থাকার তাগিদে চলে যান রাঙামাটি। সর্বশেষ ৫ বছর পর এলাকায় ফিরে এসে তিনি আবারও কোন রকম মাথা গোঁজার ঠাঁই করেছেন। তবে ইতোমধ্যে বাড়ির সামনে দিয়ে ফাঁটল শুরু হওয়ায় অশনির আতঙ্কে যে কোনো সময় ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের আশংকায় স্বপরিবারে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। আর পুনরায় তার বসতঘরটি কোনোরকম ক্ষতিগ্রস্থ হলে সর্বস্ব হারিয়ে পরিবার নিয়ে ভিটে মাটি ছেড়ে পথে বসতে হবে তাকে।
একই এলাকার বাসিন্দা শিক্ষক মিলন হোসেন সহ একাধিক ব্যক্তি জানান, এমনিতেই সারাবছর নদীতে জোয়ারের পানি তুলনামূলক বেশি হলেই রাস্তা ছাপিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। খুলনাঞ্চলে ২ নম্বর সংকেত চলছে। জোড়শিং ট্যাকের মাথার পয়েন্টে জরুরি ভিত্তিতে কাজ না করলে যদি অশনির কোন রকম প্রভাব পড়ে তাহলে ওই স্থান ভেঙে হাজার হাজার বিঘা মৎস্য ঘের, ফসলি জমি, কাচা-ঘরবাড়ি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন জানান, উপকূলীয় কয়রার মানুষের দীর্ঘ দিনের দাবি টেকসই বেড়িবাঁধ। তবে আম্পান ও ইয়াস পরবর্তী ষাট দশকের জরাজীর্ণ বেড়িবাঁধ সংস্কারে পানি উন্নয়ন বোর্ড ব্যাপক কাজ করেছে। তবে কিছু এলাকায় কাজ না করায় ওই সকল এলাকার সর্বসাধারণের মাঝে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের আংটিহারা, খাসিটানা, জোড়শিং, মাটিয়াভাঙ্গা এলাকা, কয়রা সদর ইউনিয়নের মদিনাবাদ লঞ্চঘাট ও মদিনাবাদ তফসিল অফিসের সামনে হতে হামকুড়ার গড়া, মহারাজপুর ইউনিয়নের দশালিয়া ও সুতির কোণা মারাত্মক ঝুঁকির মুখে রয়েছে।
কয়রা উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আলহাজ্ব এস এম শফিকুল ইসলাম জানান, পূর্ব মধ্য বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় অশনি বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানতে পারে। এ অবস্থায় ঘূর্ণিঝড়কে কেন্দ্র করে ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বরদেরকে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে ১১৮টি আশ্রয় কেন্দ্রের পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগানো হবে। তাছাড়া ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতি এড়াতে সরকারি কর্মকর্তা, সিপিপি, বেসরকারি এনজিও’র স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করবেন।
সেকশন-২ সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শামিম হাসনাইন মাহামুদ বলেন, আম্পান ও ইয়াসের পর থেকে কয়রা উপজেলায় ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধে কাজ চলছে। তবে ঘুর্ণিঝড় অশনিতে কয়রা উপজেলার দুই থেকে আড়াই কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের প্রতিনিধিরা চিহ্নিত ওই সকল এলাকায় কাজ করছেন।