জেলা প্রতিনিধি, গোপালগঞ্জ: আজ ১৯ ডিসেম্বর কাশিয়ানী মুক্ত দিবস। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলেও গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলা শত্রæ মুক্ত হয় এইদিনে। মিত্র ও মুক্তি বাহিনীর ত্রিমুখী আক্রমণে পাকিস্তান সেনা বাহিনীর দখলে থাকা কাশিয়ানীর ভাটিয়াপাড়া ওয়্যারলেস স্টেশনের ক্যান্টনমেন্টের পতন ঘটে। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হলেও কাশিয়ানীর ভাটিয়াপাড়ায় স্বাধীন বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা ওড়ে ১৯ ডিসেম্বর সকালে।
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে ফরিদপুর থেকে এক প্লাটুন সশস্ত্র খানসেনা রেলযোগে কাশিয়ানী অদূরবর্তী ভাটিয়াপাড়া ওয়ারলেস সেন্টার দখল করে এবং সেখানে তারা অবস্থান নেয়। স্থানীয় মুসলিম লীগ ও পিডিপি নেতাদের সহযোগিতায় রাজাকার, আলবদর, আল শামস শান্তি কমিটি গঠন করে এলাকায় লুটতরাজ, খুন, অগ্নিসংযোগ, নারী ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরণের অত্যাচার-নিপীড়ন চালাতে থাকে।
১৩ এপ্রিল আওয়ামী লীগ নেতা এমএম আমজাদ হোসেন, বাগঝাপা গ্রামের মোক্তার শেখ, মাজড়ার হাবিবুর রহমান বাবু মিয়ার বাড়িসহ শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে খানসেনারা।
মাজড়া গ্রামের জহির উদ্দিন মৌলভীর ছেলে বেলায়েত, যদু মিয়ার স্ত্রী ও বাগঝাপার আক্কাস শেখকে গুলি করে হত্যা করে। পরদিন ১৪ এপ্রিল পোনা গ্রামের ৬টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে এবং রাজাকার খোকা মৌলভীসহ ১১ জনকে গুলি করে হত্যা করে। দিনদিন পাক সেনাদের অত্যাচার বাড়তে থাকে। তারা কাশিয়ানী উপজেলার প্রায় পাঁচ শতাধিক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ধ্বংস ও লুটতরাজ করে। শত শত নারী ধর্ষণের শিকার হয়।
মে মাসের শেষদিকে ফিরোজ খালিদ ও আক্কাস হোসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। জুলাই-আগস্ট মাসে ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা এলাকায় প্রবেশ করে যুদ্ধ শুরু করে দেয়। ওড়াকান্দি মিড উচ্চ বিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল গঠন করে ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন স্থানীয় এমএলএ নুরুল কাদির জুন্নুর ছোট ভাই ইসমত কাদির গামা।
এছাড়াও রামদিয়া এসকে কলেজ, সাজাইল গোপী মহন উচ্চ বিদ্যালয়, রাতইল স্কুল, জয়নগর স্কুলসহ অনেক স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প স্থাপন করে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। অক্টোবর মাসে উপজেলার ফুকরা লঞ্চঘাট এলাকায় খুলনা থেকে তিনটি লঞ্চ যোগে আসা খান সেনাদের সাথে মুক্তি বাহিনীর ৬ ঘন্টাব্যাপী মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এ যুদ্ধে ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। মুক্তিসেনারা খানবাহিনীর একটি লঞ্চ ডুবিয়ে দেয় ও দেড় শতাধিক পাক সেনাকে হত্যা করে।
নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ নাগাদ কাশিয়ানীর অধিকাংশ এলাকা শত্রæমুক্ত হলেও শতাধিক খান সেনা ও রাজাকার কাশিয়ানীর ভাটিয়াপাড়া ওয়ারলেস সেন্টারে সুরক্ষিত বাঙ্কার করে অবস্থান নেয়। কাশিয়ানীর প্রায় ১২০০ মুক্তিযোদ্ধা চতুর্দিক থেকে সেই ক্যাম্পে আক্রমণ চালাতে থাকে। কিন্তু মাটির নিচে শক্ত বাঙ্কার করে অবস্থান নেওয়ার ফলে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। ডিসেম্বর মাসের ৬ তারিখ যশোর থেকে ক্যাপ্টেন কেএন হুদা এবং ফরিদপুর থেকে লেফটেন্যান্ট কমল ছিদ্দিকী, ক্যাপ্টেন বাবুল তাদের বাহিনী নিয়ে কাশিয়ানীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দিয়ে সম্মিলিতভাবে আক্রমণ শুরু করে। ক্যাপ্টেন হুদা ইংরেজি, পাঞ্জাবী ও বালুচ ভাষায় হানাদার সেনাদের আত্মসর্পণ করার আহŸান জানান।
মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আজিজুর রহমান খেপু মুন্সি ১৯ ডিসেম্বর ছাব্বির নামের এক পাকসেনাকে আটক করে পাকসেনা ক্যাম্পে বাংলাদেশ স্বাধীতার হবার সংবাদ জানায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কঠিন প্রতিরোধের মুখে বিকেল তিনটায় ৬৫ জন হানাদার বাহিনীসহ শতাধিক রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসর্পণ করে। এ সময়ে একজন খানসেনা নিজের রাইফেল দিয়ে নিজের বুকে গুলি করে আত্মহত্যা করে।
কাশিয়ানীতে বিজয়ের তিন দিন পর পথে পথে জয়বাংলা ধ্বনিসহ আনন্দ মিছিল করে জনতা। আর সেই সাথে ১৯ ডিসেম্বর শত্রæ মুক্ত হয় কাশিয়ানী। স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য্য উদিত হয় কাশিয়ানীতে।
বীরমুক্তিযোদ্ধা শাহ্ শওকত আলী বলেন, ‘সারাদেশ ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হলেও আমরা কাশিয়ানীর মুক্তিযোদ্ধারা দীর্ঘদিন যুদ্ধের পর ১৯ ডিসেম্বর বিকালে স্বাধীনতা পাই। ১৬, ১৭, ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বরেও আমরা মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করেছি। সেখান থেকেই আমরা কাশিয়ানীর মুক্তিযোদ্ধারা ১৯ ডিসেম্বর মুক্ত দিবস পালন করি।’
-লিয়াকত হোসেন লিংকন