,

আওয়ামী লীগে পদ পেয়েই বেপরোয়া কয়রার বাহারুল

নিজস্ব প্রতিবেদক: খুলনার কয়রার এক মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে পেটানোর পর আলোচনায় এসেছেন সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এস এম বাহারুল ইসলাম।

স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের মারধর, মাছের ঘের দখল, প্রেস ক্লাবে হামলা, ভোটের দিন কেন্দ্র দখল, সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ শিকারের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করলে প্রকাশ্যে মারধরের শিকার হতে হয়। তার সংগঠনের অন্য নেতাকর্মীরাও এ অভিযোগ করেছেন।

কয়রা উপজেলা যুবলীগের সহসভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘এস এম বাহারুল ইসলাম বেপরোয়া হয়ে ওঠেন ২০০৯ সালে কয়রা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ার পর থেকে। তার সঙ্গে স্থানীয় উচ্ছৃঙ্খল ১০-১৫ জন যুবক থাকে। তাদের সঙ্গে নিয়ে এসব অপকর্ম করে বেড়ান বাহারুল।

‘২০১৮ সালে কয়রা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন তিনি। তাতে তার ক্ষমতা আরও বেড়ে যায়। এখন কয়রার মানুষ তার কাছে জিম্মি। তার বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস কারও নেই।’

২০০৯ সালে বাহারুল ইসলাম ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ার পর কয়রা উপজেলার ৬৫টি মাছের ঘের দখল করেন বলে অভিযোগ আছে। ওই সময় সাংবাদিকরা তার বিরুদ্ধে সংবাদ করায় তিনি ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। দলবল নিয়ে হামলা চালিয়েছিলেন কয়রা উপজেলা প্রেস ক্লাবে।

সে সময় কয়রা উপজেলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি ছিলেন মোস্তফা শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ওই হামলার পর আমরা ২১ দিন ক্লাব বন্ধ রেখেছিলাম। তখন সংসদ সদস্য ছিলেন সোহরাব আলী সানা, আমরা তার কাছে আহ্বান করেছিলাম। তখন সংসদ সদস্যও আমাদের সহায়তা করেননি। তাই আমরা মামলা করতে সাহস পাইনি। তখন টিকে থাকাই আমাদের দায় ছিল।’

২০১৩ সালে পুলিশের সঙ্গে ছাত্রলীগের গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছিল উত্তর বেদকাশি কাছারিবাড়ী ঐতিহাসিক বটতলা বৃক্ষমেলায়। ওই মামলার আসামি ছিলেন বাহারুল ইসলাম।

মেলা আয়োজন কমিটির সভাপতি সরদার নুরুল ইসলাম বলেন, ‘গুলির ঘটনায় মামলা হয়েছিল। এটা নিজেদের দলীয় বিষয়, তাই আর বলতে চাচ্ছি না। আমরা মামলা তুলে নিয়েছি।’

২০১৪ সালে বাহারুল ইসলাম হামলা চালান কয়রা উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মাওলা বক্সের ওপর।

মাওলা বক্স বলেন, ‘তখন আমি লোকসমাজ পত্রিকায় কাজ করতাম। নিরপেক্ষ সংবাদ করার বাহারুল আমার ওপর হামলা করেছিল। তার ভয়ে পরে মামলা করতেও সাহস পাইনি। বাহারুল ওই সময়ে দুর্ধর্ষ ছিল। তার হাতে মার খায়নি, কয়রায় এমন সাংবাদিক খুবই কম আছে।’

২০১৬ সালে বাহারুলের হাতে হামলার শিকার হয়েছিলেন কয়রা উপজেলার আরেকজন সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মতিউর রহমান। ২০২০ সালে তিনি মারা যান।

তার ছেলে মিজানুর রহমান বলেন, ‘২০১৬ সালে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে আমার বাবাকে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দিতে চেয়েছিল। তবে আমার বাবার তেমন অর্থ না থাকায় তিনি মনোনয়ন নিতে চাননি। পরে নৌকা প্রতীক পেয়েছিল বাহারুল ইসলাম। আমার বাবা তাকে সমর্থন না করে বাহারুলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী শফিকুলের পক্ষে কাজ করেছিলেন। ভোটে শফিকুল জয় লাভ করেন। সেই জন্য বাহারুল আমার বাবাকে মারধর করেছিলেন।’

২০২১ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আবার নৌকার মনোনয়ন পান বাহারুল ইসলাম। এ নির্বাচনে ভোটের দিন কেন্দ্র দখলের অভিযোগ উঠেছিল তার বিরুদ্ধে।

তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘ভোটের দিন ৪ নম্বর কয়রা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাহারুলসহ তার ছেলে গিয়ে অনেককে মারধর করেন। তখন ওই কেন্দ্রের ফলাফল স্থগিত করেছিল নির্বাচনি অফিস। দুই মাস পর ওই কেন্দ্রে আবার ভোট হয়।’

অভিযোগ রয়েছে, এ নির্বাচনে বিজয়ের পর আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন বাহারুল ইসলাম। শুরু করেন সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ ধরার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ।

মহারাজপুরের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ-আল মাহমুদ বলেন, ‘কিছুদিন আগে আমার ইউনিয়নের এলাকা থেকে কয়েকজনকে সুন্দরবন থেকে বিষ দিয়ে শিকার করা মাছসহ আটক করেছিল স্থানীয়রা। পরে তাদের মহারাজপুর ইউনিয়ন পরিষদে আনা হলে তারা জানায় এই মাছ বাহারুলের। তখন তাদের পুলিশ দিয়ে দিয়েছিলাম। ওইদিন কয়রা সদরে গেলে বাহারুল দলবল নিয়ে আমার ওপর চড়াও হয়। পরে থানার ওসি মিটমাট করে দেন।’

আব্দুল্লাহ-আল মাহমুদ আরও বলেন, ‘বাহারুল কেন্দ্র দখল করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচিত হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে অন্তত ৫ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। বর্তমানে কয়রার কপোতাক্ষ কলেজের পাশে একটি জায়গা দখল করে চারতলা ভবন তৈরি করছেন।’

সর্বশেষ খুলনার কয়রায় মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে পিটিয়ে জখম করার অভিযোগে এস এম বাহারুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব।

খুলনা শহরের ভাড়া বাসা থেকে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে বাহারুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে আদালতে তোলা হলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

আহত শিক্ষক মাসুদুর খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তিনি জানান, গত সোমবার তিনি মাদ্রাসায় কাজ করছিলেন। ওই সময় বাহারুল ইসলামের নেতৃত্বে স্থানীয় ইউনুসুর রহমান, নিয়াজ হোসেন, মাসুদুর রহমান, মিলন হোসেন, জহুরুল ইসলাম, রিয়াল, আমিরুল, অমিত মণ্ডল, রফিকুল গাজী, সাদিকসহ ১৫-২০ জন তাকে ধরে নিয়ে যান।

তিনি বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানের সাবেক অধ্যক্ষ মোস্তফা আব্দুল মালেকের উপস্থিতিতে বাহারুল আমাকে গালাগাল করতে থাকেন। একপর্যায়ে তারা আমাকে মাটিতে ফেলে চোখে, ঘাড়ে, কানে, পিঠে এলোপাতাড়ি পেটাতে থাকেন। এরপর সেখান থেকে তুলে নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের একটি কক্ষে নিয়ে আটকে রাখেন। সেখানেও বেদম মারপিট করা হয়।

‘এতে আমার চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কানের পর্দা ফেটে যায়। একপর্যায়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।’

তিনি আরও বলেন, ‘জ্ঞান ফিরলে চেয়ারম্যান আমাকে মাদ্রাসা থেকে পদত্যাগ করতে বলেন। পরে কয়রা থানার এস আই মনিরুল ইসলাম আমাকে উদ্ধার করেন।

‘প্রথমে আমাকে স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন পরিবারের সদস্যরা।’

অধ্যক্ষ জানান, তার মাদ্রাসাটি ঢাকার ইসলামিক অ্যারাবিক ইউনিভার্সিটির আওতাভুক্ত। তিন মাস আগে কলেজে সভাপতির দায়িত্ব দেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনজনের নাম চাওয়া হয়েছিল। তখন চেয়ারম্যান বাহারুল তার নাম দিতে জোর করেছিলেন।

তিনি বলেন, ‘বাধ্য হয়ে বাহারুলসহ তিনজনের নাম প্রস্তাব করেছিলাম, তবে ইউনিভার্সিটি থেকে সেটা রিজেক্ট করে নতুন করে কমিটি দিতে বলা হয়েছিল।

‘পরে আমি মহারাজপুরের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ-আল মাহমুদসহ তিনজনের নাম প্রস্তাব করে আরেকটি কমিটি জমা দিই। তখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মহারাজপুরের চেয়ারম্যানকে সভাপতি ঘোষণা করা হয়।’

অধ্যক্ষ বলেন, ‘এর পর থেকেই সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাহারুল আমাকে হুমকি দিয়ে আসছিলেন। কয়েক দিন আগে আমার কাছ থেকে ১ লাখ টাকা চাঁদা নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সভাপতি হতে পারিনি, তখন আমার কিছু টাকা খরচ হয়েছিল। সেই জন্য ১ লাখ টাকা দিতে হবে। প্রাণের ভয়ে টাকা দিয়েছি।

‘তার পরও তিনি আমাকে তুলে নিয়ে মারধর করেছেন। বলেছেন, অধ্যক্ষের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে। না হলে এলাকায় ফিরতে পারব না। থানায় জানালেও মামলা না নিয়ে প্রথমে বিষয়টি মিটমাট করতে বলা হচ্ছিল, পরে পত্রপত্রিকায় লেখা হলে থানা মামলা নিয়েছে।’

কয়রা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ বি এম এস দোহা বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাত ১২টার দিকে অধ্যক্ষের স্ত্রী বাদী হয়ে ১২ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ১০-১৫ জনকে আসামি করে থানায় মামলা করেছেন। এ মামলার অন্যতম আসামি সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে র‍্যাব গ্রেপ্তার করে। তিনি বর্তমানে কারাগারে আছেন।’

বাহারুলের কর্মকাণ্ডে বিব্রত আওয়ামী লীগ

দলীয় পদকে ব্যবহার করে নানা অপকর্ম করায় এস এম বাহারুল ইসলামকে নিয়ে বিব্রত আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। তবে কেউ অভিযোগ দিতে সাহস না পাওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুজিত অধিকারী বলেন, ‘বাহারুলের অনেক কর্মকাণ্ড ইতোমধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সর্বশেষ শুনেছি অধ্যক্ষকে মারধর করার জন্য তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন। দল থেকে তাকে সমর্থন করব না। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হারুনুর রশীদ বলেন, ‘আমরা খুব তাড়াতাড়ি বাহারুলের বিষয়ে আলোচনায় বসব।’

বাহারুলের কর্মকাণ্ডের কথা শুনে বিব্রত বোধ করেছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, ‘বাহারুলের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর