,

ওড়াকান্দির ট্র্যাজেডির ১৫ বছর

লিয়াকত হোসেন (লিংকন): গতকাল শনিবার ছিল ওড়াকান্দি ট্র্যাজেডির ১৫ তম বার্ষিকী। ২০০৫ সালের এই দিনে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ওড়াকান্দি ঠাকুরবাড়ীতে ঘটেছিল এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। পুণ্যভূমি শ্রীধাম ওড়াকান্দিতে পূর্ণব্রক্ষ্ম শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে বারুণী স্নানোৎসব পদদলিত হয়ে ৪ মহিলাসহ ৭ জন নিহত হয়েছিল।

সে দিনে নিহতরা হলেন বাগেরহাট সদর উপজেলার দৃষ্টিপুর গ্রামের আরতী পালিত (৬০), ফকিরহাট উপজেলার মৌবোগ গ্রামের মিলন ধর (১০), বরিশাল জেলার উজিরপুর উপজেলার হাবিবপুর গ্রামের আরতী মালো (৬০), খুলনা জেলার ডুমরিয়া উপজেলার লাইন পাবলা গ্রামের পুতুল পাত্র (৪৫), বটিয়াঘাটা উপজেলার জলমা চক্রাখালী গ্রামের চন্দ্র কান্ত হালদার (৫৭) গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলার লক্ষীপুর গ্রামের জিলাপী দাস (৬২), মুকসুদপুর উপজেলার কৃষ্ণাদিয়া গ্রামের মহাদেব দে (৬০)।

যেভাবে ঘটনা ঘটে, সকাল ৭ টার দিকে ঠাকুরবাড়ী হরি মন্দিরের সামনে এ ঘটনা ঘটে। সেদিন ছিল হরিচাঁদ ঠাকুরের ১৯৪ তম আর্বিভাবোৎসব। স্নানোৎসব শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পর মতুয়া ভক্তরা ঢাক-ঢোল, কাশি-বাঁশি বাজাতে বাজাতে লাল নিশানা উড়িয়ে “হরিবোল হরিবোল”ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে মিছিল সহকারে ওড়াকান্দি ঠাকুরবাড়ীতে প্রবেশ করতে থাকে।

ক্রমেই হরি মন্দিরের সামনে প্রচন্ড মানুষের চাপ বাড়তে থাকে। তখন হাজার হাজার লোকের সমাগম নিয়ন্ত্রণ করতে স্বেচ্ছাসেবক কর্মী ও আনসার এবং পুলিশ বাহিনী হিমশিম খায়। এ সময় হরি মন্দিরের সামনে কিছু জায়গায় বড় বড় গর্ত থাকায় লোকজনের চলাচলে ধীরগতি হয়।

এছাড়া রাস্তার পাশে বিভিন্ন দোকানপাট বসায় ভক্তদের যাতায়াতের জন্য ছিল অপ্রশস্ত। তখন প্রচন্ড চাপে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মানুষ। পায়ের তলায়পিষ্ট হয়ে এবং নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে ৭ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় আরো অন্তত শতাধিক নারী-পুরুষ আহত হয়।

মারাত্মক আহদের কাশিয়ানী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও রামদিয়া বিভিন্ন ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। তখন মানুষ দিগ্বিদিক হন্যে হয়ে স্বজনদের খুঁজতে থাকে।

এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনার খবর মুহূর্তের মধ্যে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। গোটা উপজেলায় নেমে আসে শোকের ছায়া। এ সময় স্বজনহারা মানুষের কান্না, আহাজারি আর চিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠে। গোটা ঠাকুরবাড়ী সৃষ্টি হয় হৃদয়বিদারক ঘটনার অবতারণা।

এ মর্মান্তিক দূর্ঘটনার পর তৎকালীন গোপালগঞ্জ জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আহমেদ আমিন চৌধুরী ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। তখন পুলিশের হ্যান্ড মাইকে সবাইকে শান্ত হতে বলেন এবং আহতদের উদ্ধার করে চিকিৎসা কেন্দ্রে নেয়া হয়। নিহতদের আত্মীয়-স্বজনরা এসে একে একে লাশ শনাক্ত করেন।

পরে লাশ যার যার গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। দূঘটনার সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুঁটে আসেন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি। সকাল সাড়ে ১০ টায় ভারতীয় হাইকমিশনার বীনাসিক্রি ওড়াকান্দি ঠাকুরবাড়ীর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

এ ঘটনায় তৎকালীন বিএনপির মহাসচিব, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয় ও সমবায় মন্ত্রী আব্দুল মান্নান ভূইয়া দূঃখ ও গভীর শোক প্রকাশ করেন।

মৃত্যু ব্যক্তিদের আত্মার শান্তির কামনা করে এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। নিহতদের স্মরণে প্রতি বছর স্নানোৎসবের প্রাম্ভে তাদের স্মৃতি ও আত্মার শান্তি কামনায় মঙ্গল প্রজ্জ্বলন এবং বিশেষ প্রার্থনা করা হয়।

উল্লেখ্য, এ বছর শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের ছিল ২০৯ তম জন্মতিথি। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে স্নানোৎসব ও বারুণী মেলা স্থগিত করা হয়েছে।  গত বৃহস্পতিবার (১৯ মার্চ) দুপুরে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে মেলার প্রস্তুতি ও করনো পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত যৌথ পর্যালোচনা সভায় মেলা স্থগিতের ঘোষনা দেন কাশিয়ানী উপজেলা চেয়ারম্যান, ঠাকুর পরিবারের সদস্য ও মেলা প্রস্তুতি কমিটির সভাপতি সুব্রত ঠাকুর হিল্টু।

সুব্রত ঠাকুর হিল্টু বলেন, করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মহামারী আকার ধারণ করেছে। সারা বিশ্ব এ ভাইরাস নিয়ে আতংকিত। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ২শ’ বছরের মহা বারুনীর মেলা সহ আনুসংগিক সবকিছু এ বছর স্থগিত করা হলো। তিনি বলেন, করোনা প্রতিরোধে জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে। সে বাস্তবতায় আমরা মেলা ও আনুসাঙ্গিক সব কিছু স্থগিতের ঘোষনা দিয়েছি।

তিনি আরো জানান, পূর্ণব্রহ্ম শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর ২শ’ বছর আগে শ্রীধাম ওড়াকান্দিতে মহাবারুনীর মেলা ও স্মানোৎসব প্রচলন করেন। পূণ্য লাভের আশায় এ অনুষ্ঠানে প্রতি বছর ভারত, নেপাল সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার ঠাকুরের ১০ লাখ ভক্তের সমাগম ঘটে।

এই বিভাগের আরও খবর