,

সবাইকে কাঁদিয়ে ‘হিমেলের বিদায়’

রাবি প্রতিনিধি: ট্রাকচাপায় নিহত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থী মাহমুদ হাবিব হিমেলের এমন বিদায় মানতে পারছে না কেউই। গতকাল বুধবার সকালে হিমেলের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে ক্যাম্পাসে আনা হলে কান্নায় ভেঙে পড়েন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও সহপাঠীরা। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ স্বামীহারা মা মনিরা আক্তার।

সকাল সাড়ে ১০টায় ক্যাম্পাসের কেন্দ্রীয় মসজিদে হিমেলের জানাজা হয়।

জানাজায় সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে। এর আগে মরদেহ চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণ এবং পরে শহীদ মিনার মুক্তমঞ্চে আনা হয়। সেখানে বিভিন্ন সংগঠন ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা মরদেহের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ফুল দেয়। বাদ জোহর জানাজা শেষে লাশ নাটোরে নিয়ে শহরের গাড়ীখানা কবরস্থানে দাফন করা হয়।
মাহমুদ হাবিব হিমেল চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক ডিজাইন, কারুশিল্প ও শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোটের দপ্তর সম্পাদক ছিলেন। কয়েক বছর আগে তাঁর বাবা মারা গেলে তিনি মায়ের সঙ্গে নানাবাড়ি নাটোরের কাপড়পট্টি এলাকায় থাকা শুরু করেন।

অভিযুক্ত ট্রাকচালক ও হেল্পার আটক, মামলা : হিমেলকে চাপা দেওয়া ট্রাকচালক মো. টিটু (৪২) এবং তাঁর সহকারী (হেল্পার) হামিম হোসেন ওরফে কালুকে (২০) গতকাল দুপুরে রাজশাহী নগরের কাশিয়াডাঙ্গা এলাকা থেকে আটক করেছে পুলিশ। তাঁরা কাশিয়াডাঙ্গার বাসিন্দা। রাজশাহী মহানগর পুলিশের কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে বিষয়টি জানান। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর আরিফুর রহমান বাদী হয়ে নগরের মতিহার থানায় মামলা করেছেন। সেই মামলায় আটককৃতদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

পাঁচ লাখ টাকার চেক হস্তান্তর : বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, ‘হিমেলের পরিবারের কাছে পাঁচ লাখ টাকার চেক হস্তান্তর করা হয়েছে। আমরা নাটোরে তার নানার বাড়িতে গিয়ে চেক হস্তান্তর করেছি। ভুক্তভোগী পরিবারটিকে ধাপে ধাপে আরো সহযোগিতা করা হবে। হিমেলের মায়ের আজীবন চিকিৎসা খরচ বিশ্ববিদ্যালয় বহন করবে। ’

সব দাবি পূরণ করা হবে : হিমেল নিহতের ঘটনায় ক্ষতিপূরণসহ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘ছয়টি দাবিই পূরণ করা হবে’ বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তার। হিমেলের জানাজায় উপাচার্য এ ঘোষণা দেন। উপাচার্য আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘কথা ছিল আমার লাশ আমার সন্তানের কাঁধে উঠবে। কিন্তু পিতাকেই সন্তানের লাশ কাঁধে নিতে হচ্ছে। ’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা হিমেলের মায়ের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছি। পর্যায়ক্রমে ক্ষতিপূরণের আরো টাকা দেওয়া হবে। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে হত্যা মামলা করা হবে। ’

শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো হলো-নিহতের পরিবারকে ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহতের বোনকে চাকরি দিতে হবে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পাল্টাতে হবে, প্রক্টরিয়াল বডির পদত্যাগ, ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং হিমেল নিহতের ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে বিচার করতে হবে।

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্বজনদের হাতাহাতি : হিমেলের জানাজা শেষে মরদেহ নিয়ে নাটোরের উদ্দেশে রওনা দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সহপাঠীরা। এতে আপত্তি জানায় হিমেলের দাদার বাড়ির স্বজনরা। বগুড়ার শেরপুরে হিমেলের দাদার বাড়ি। হিমেলের সহপাঠীরা জানান, বাবার মৃত্যুর পর হিমেল মায়ের কাছে নাটোরে থাকতেন। সেখানে দাদার বাড়ির কেউ তাঁদের খোঁজ নেয়নি। তাই হিমেলের মায়ের কাছে লাশ পৌঁছানো হবে। মা-ই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। অন্যদিকে হিমেলের চাচা মো. মিরাজ জানান, হিমেলের বাবার ইচ্ছা ছিল তাঁর পাশের কবরটি যেন তাঁদের স্বজনের মধ্যে কারো হয়। হিমেল দাদার বাড়িতে বড় হয়েছে। সেখানে হাজার হাজার মানুষ হিমেলের জানাজা পড়ার জন্য অপেক্ষা করছে।

এক পর্যায়ে হিমেলের চাচাতো ভাই পরিচয় দেওয়া এক স্বজন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করছিলেন। শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করলে তাঁদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে তাঁর স্বজনরা মাইক্রোবাসযোগে ক্যাম্পাস ত্যাগ করে। এ সময় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা মাইক্রোবাসটি ভাঙচুরের চেষ্টা চালায়। উপস্থিত শিক্ষক আতাউর রহমান ও কাজী মামুন হায়দার শিক্ষার্থীদের শান্ত করেন।

দায়িত্বে ‘অবহেলা’, প্রক্টরকে প্রত্যাহার : হিমেল নিহত হওয়ার ঘটনায় প্রক্টরিয়াল বডির প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থান এবং দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ তুলে শিক্ষার্থীরা প্রক্টর লিয়াকত আলীকে প্রত্যাহারের দাবি জানান। দুর্ঘটনার পর মঙ্গলবার রাতেই প্রক্টরকে প্রত্যাহার করা হয়। তাঁর স্থলে গতকাল দুপুরে গণিত বিভাগের অধ্যাপক আসাবুল হককে প্রক্টরের দায়িত্ব দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

এই বিভাগের আরও খবর