,

শহীদ লে. বদিউজ্জামানের শাহাদত বার্ষিকী আজ

লিয়াকত হোসেন লিংকন: আজ ৩ ডিসেম্বর শহীদ বদিউজ্জামানের ৪৯ তম শাহাদৎবার্ষিকী। ১৯৭১ সালের এই দিনে ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট রেলপথে আখাউড়া রেল জংশনের কাছে আজমপুর রেল স্টেশনের কাছে সম্মুখযুদ্ধে শাহাদত বরণ করেন তিনি।

তরুণ সৈনিক শহীদ লেফটেন্যান্ট ইবনে ফজল বদিউজ্জামান ১৯৪৯ ইং সালে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার নাটগ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা শেখ ফজলুর রহমান ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান পুলিশ অফিসার। শহীদ বদিউজ্জামান ছাত্রজীবন থেকে একজন তুখোড় ছাত্র নেতা ছিলেন। দেশসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার জন্য সশ্রদ্ধ চিত্তে ১৯৭০ সালে তৎকালীন সেনাবাহিনীর আর্মড কোরে যোগদান করেন।

১৯৭১ সালে সারাদেশে শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধা। ২৫ মার্চ সারা বাংলার মানুষ পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালো, ঠিক তখন শহীদ বদিউজ্জামানও আর নিশ্চুপ বসে রইলেন না। কিন্তু পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যাতে করে কোন রূপ বিদ্রোহ না করতে পারে, সে জন্য সকল বাঙালি সেনা কর্মকর্তাকে সেনানিবাসে আটকে রাখা হয়। লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামান অতি সাহসিকতার সাথে পাকবাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে রংপুর সেনানিবাস থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে ‘১৯৭১-এর জুন মাসে ভারত চলে যান। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের উপর বিশেষ ট্রেনিং নিয়ে আগষ্ট মাসে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ২য় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করেন।

তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন পাক বাহিনীর সাথে লড়াই করে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময় অতি সাহসিকতার সাথে এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে বেশ কিছু এলাকা শত্র“মুক্ত করেন এবং মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য তিনি নিজের জীবনকে বাজি রেখে শত্র“র বিরুদ্ধে লড়াই করেন। মা হাজেরা বেগমের অহংকার তাঁর ছেলে বদিউজ্জামান সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষিত কমিশন অফিসার। বাঙালির স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে। তাঁর ছেলে দেশ স্বাধীন করে ফিরে আসবে মায়ের বুকে। মা বিজয়ের আনন্দ বুকে নিয়ে পথ চেয়ে আছেন এই বুঝি স্বাধীন দেশের পতাকা উড়াতে, উড়াতে ঘরে আসছে আমার ছেলে বদিউজ্জামান।

কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের রাত। মাঝে মাঝে ভেসে আসছে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। রাতে যুদ্ধবিরতির সময় পরিশ্রান্ত মুক্তিযোদ্ধারা বিশ্রাম নিচ্ছেন। কেউ আধা ঘুমে, কেউ জেগে। এমন সময় হঠাৎ তাঁদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি সেনারা। নিমেষে শুরু হয়ে যায় তুমূল যুদ্ধ। চারদিকে বারুদের উৎকট গন্ধ, গোলাগুলিতে প্রকম্পিত। এ রকম যুদ্ধে রক্তপাত, একাধিক মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী।

লেফটেন্যান্ট ইবনে ফজল বদিউজ্জামান এতে বিচলিত হননি। সাহসিকতার সঙ্গে তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ মোকাবিলা করেন। সমান তালে যুদ্ধ চলে। একপর্যায়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের তীব্রতা প্রচন্ডভাবে বেড়ে যায়। মুহুর্মুহু শেল ও রকেট এসে পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আহতের সংখ্যা ক্রমে বাড়ে। তাঁদের আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ে সহযোদ্ধাদের মধ্যে। আক্রমণের প্রচন্ডতায় মুক্তিযোদ্ধারা কিছুটা বিশৃঙ্খলা হয়ে পড়েন। কেউ কেউ পিছু হটে যান। এই পরিস্থিতিতে অধিনায়কের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। লেফটেন্যান্ট ইবনে ফজল বদিউজ্জামান অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সেই ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করেন।

সেদিন প্রচন্ড গোলাগুলির মধ্যে নিজের জীবন বাজি রেখে সহযোদ্ধাদের মনে সাহস জুগিয়ে তাঁদের ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় সহযোদ্ধারা পুনঃসংগঠিত ও অনুপ্রাণিত হয়ে সাহসিকতার সঙ্গে পাল্টা আক্রমণ চালান। তাঁদের বীরত্বে থেমে যায় বেপরোয়া পাকিস্তানি সেনাদের অগ্রযাত্রা। যুদ্ধ চলতে থাকে। সারা দিন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর মুক্ত হয় আজমপুর রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন এলাকা। পাকিস্তানী সেনারা পালিয়ে যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের দিকে।

যুদ্ধের একপর্যায়ে লেফটেন্যান্ট ইবনে ফজল বদিউজ্জামান অগ্রভাগে থেকে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। হতোদ্যম পাকিস্তানি সেনারা তখন পিছু হটছে। এমন সময় হঠাৎ পাকিস্তানি সেনাদের ছুঁড়া আর্টলারী সেলের একঝাঁক গুলি এসে লাগে তাঁর শরীরে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। সহযোদ্ধারা উদ্ধার করার আগেই নিভে যায় তাঁর জীবন প্রদীপ। এ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে।

১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর। ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট রেলপথে আখাউড়া রেল জংশনের কাছে আজমপুর রেল স্টেশনের অবস্থান। আখাউড়ার অদূরে ভারতের সীমান্ত শহর ও ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা। আখাউড়া-আজমপুর ১৯৭১ সালে সামরিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ৩০ নভেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই এলাকায় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেদিন যুদ্ধ চলাকালেই সহযোদ্ধারা শহীদ ইবনে ফজল বদিউজ্জামানকে সমাহিত করেন আজমপুর রেল স্টেশনের পাশেই। তাঁর সমাধি সংরক্ষিত। স্বাধীনতার পর তাঁর নামে ঢাকা সেনানিবাসের একটি সড়কের নামকরণ করা হয়। কয়েক বছর আগে সেই সড়কের পুনরায় নামকরণ করে ‘স্বাধীনতা সরণি’ করা হয়েছে। বগুড়া সেনানিবাসে স্থাপন করা হয়েছে লেফটেন্যান্ট শহীদ বদিউজ্জামান প্যারেড গ্রাউন্ড।

শহীদ বদিউজ্জামানকে স্মরণীয় করে রাখার লক্ষ্যে পারিবারিক পৃষ্ঠপোষকতায় বোন হীরা নওশেন (কণ্ঠ শিল্পী) এর তত্ত¡াবধানে প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে স্মরণ সভা আয়োজনের মাধ্যমে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের লেফটেন্যান্ট শহীদ বদিউজ্জামান স্মৃতি’ পদক প্রদান করা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নবীন সেনা কর্মকর্তা (লেফটেন্যান্ট) ইবনে ফজল বদিউজ্জামান ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন ২৯ ক্যাভেলরি (লঞ্চার) ইউনিটে। এর অবস্থান ছিল রংপুর সেনানিবাসে। ২৫ মার্চের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেখানে কর্মরত বাঙালি দু’জন সেনা কর্মকর্তা ছাড়া তাঁকেসহ অন্যান্য বাঙালি সেনা কর্মকর্তাকে বন্দী এবং বেশির ভাগকে পরে হত্যা করে। তবে তাঁকে হত্যা করেনি। ২ আগস্ট তিনি সেনানিবাস থেকে পালিয়ে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।

মুক্তিযুদ্ধে, বিশেষত আজমপুরের যুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য শহীদ ইবনে ফজল বদিউজ্জামানকে তৎকালীন বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত মরণোত্তর (বীরপ্রতীক) খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ২০। শহীদ ইবনে ফজল বদিউজ্জামানের অবিবাহিত ছিলেন। চার ভাই তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। ক্ষণজন্মা এ পৃথিবীতে অনেকেই আসেন আবার অনেকেই নীরবে চলে যান। কিন্তু কোন কোন ব্যক্তি পৃথিবীর বুকে রেখে যান অম্লান কীর্তি। শহীদ বদিউজ্জামান ঠিক এমনি এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন যা বাংলার ইতিহাসে চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

এই বিভাগের আরও খবর