,

রেলই রেখেছে টিকিট কালোবাজারির সুবিধা

বিডিনিউজ ১০, ডেস্কট্রেনের টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে রেলওয়ের লোকজনই জড়িত। একটি গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানেও বিষয়টি উঠে এসেছে। এ নিয়ে সোমবার ‘যাত্রী পায় না, ট্রেনের টিকিট থাকে অবিক্রীত : চক্রে স্টেশন মাস্টার থেকে গার্ড সবাই’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়।

এরপর দু’দিনে টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে সম্পৃক্ত ১৫ জনকে বদলি করেছে কর্তৃপক্ষ। পর্যায়ক্রমে অন্যদেরও বদলি করা হবে এবং তদন্তের পর তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেল কর্তৃপক্ষ তথা মন্ত্রণালয়ই রেল কর্মচারীদের টিকিট কালোবাজারির সুযোগ করে দিয়েছে। ভিআইপিসহ নানা কোটার নামে টিকিটের একটি অংশ রেখে দেয়া হয়। এর পরিমাণ ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। আর রেখে দেয়া এসব টিকিটের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই শেষ পর্যন্ত বিক্রি হয় না। এসব অবিক্রীত টিকিট নানাভাবে শেষ পর্যন্ত কালোবাজারেই যায়। ট্রেনে আসন কখনও খালি যায় না।

সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, টিকিট বিক্রিতে কোনো স্বচ্ছতা নেই। এ কারণেই সহজেই টিকিট চলে যায় কালোবাজারে। গেল ঈদের সময়ে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন ঘোষণা দিয়েছিলেন, এখন থেকে আর কোনো কোটা থাকবে না। অর্ধেক টিকিট অনলাইনে বিক্রি করা হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, কোটাব্যবস্থা এখনও বিদ্যমান। আর মোট টিকিটের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ ছাড়া হয় অনলাইনে। সূত্রমতে, এখানেও রয়েছে শুভংকরের ফাঁকি। প্রথম শ্রেণি বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিন (বাথ ও সিট), স্নিগ্ধার (এসি) টিকিট ১০ শতাংশও ছাড়া হয় না অনলাইনে।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, এপ্রিল থেকে আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট কাটতে জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধন নম্বর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ পদ্ধতির কার্যকর ব্যবহার শুরু হয়নি। যার-তার নাম-মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে কেটে রাখা টিকিট চলে যাচ্ছে কালোবাজারে। যে নম্বর দিয়ে টিকিট কাটা হচ্ছে, তা কর্তৃপক্ষের কাছে থাকলেও ওই নম্বরে কোনো বার্তা (মেসেজ) যাচ্ছে না। ফলে খুব সহজেই অবৈধ আর্থিক লেনদেনে টিকিট কালোবাজারে যাচ্ছে।

সূত্র জানায়, রেলওয়েতে বর্তমানে ৩৫৮টি ট্রেন চলাচল করছে। এর মধ্যে ৯৬টি আন্তঃনগর ট্রেনে প্রতিদিন প্রায় ৬৫ হাজার টিকিট বরাদ্দ। বাকিগুলো মেইল ও লোকাল ট্রেন, এতে ৩২ হাজার টিকিট বরাদ্দ। আন্তঃনগর ট্রেনের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ অনলাইনে বিক্রি করা হয়। বাকি টিকিট কাউন্টার থেকে বিক্রি হয়। আর মেইল ও লোকাল ট্রেনের সব টিকিটই কাউন্টার থেকে বিক্রি করা হয়ে থাকে। ৩৫৪টি স্টেশন থেকে মোট ৯৭ হাজার টিকিট প্রতিদিন বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু কোনো কোনোদিন ৩০ থেকে ৩৫ হাজার পর্যন্ত টিকিট অবিক্রীত থাকে।

এর আগে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে আসে, টিকিট বিক্রি না করে টিকিট নেই বলে জানানো হয় যাত্রীদের। ওই আসন নম্বর জানিয়ে দেয়া হয় ট্রেনে থাকা সংশ্লিষ্টদের। ট্রেনে থাকা যাত্রীদের কাছে তা উচ্চমূল্যে বিক্রি করেন গার্ড, টিটি, অ্যাটেনডেন্ট ও পুলিশ সদস্যরা। পরে ওই অর্থ চক্রের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়।

সূত্র জানায়, ২০১২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এক পরিপত্রের মাধ্যমে সব আন্তঃনগর ট্রেনে বিচারপতি, সংসদ সদস্য, ভিআইপি, প্রতিবন্ধী, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও অন্যান্য কোটায় নির্ধারিত সংখ্যক আসন সংরক্ষণের নির্দেশ হয়, যা রেলওয়ে আইনে নেই। এসব কোটাকে রেলের ভাষায় বলা হয় ‘অটো কোটা’।

২৬ নভেম্বর রেলভবনে অনুষ্ঠিত মাসিক পরিচালন পর্যালোচনা সভায় কাউন্টারের টিকিট ও অনলাইনের টিকিট এক তারিখে উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পাশাপাশি ভিআইপিদের জন্য বিশেষভাবে সংরক্ষিত টিকিটগুলো ৪৮ ঘণ্টা আগে কাউন্টার বা অনলাইনে উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু সূত্র বলছে, এখনও ১২ ঘণ্টা আগে উন্মুক্ত করা হয়ে থাকে।

সূত্র জানায়, যায়, তূর্ণা এক্সপ্রেস ট্রেনে ভিআইপিদের জন্য সংরক্ষিত থাকে ৬২টি টিকিট, মহানগর প্রভাতী ও গোধূলি ট্রেনে ৬০টি করে, সুবর্ণ এক্সপ্রেসে ৬৮টি করে টিকিট ভিআইপিদের জন্য সংরক্ষণ করা থাকে। তূর্ণায় বিচারপতি, সংসদ সদস্য, সেনাবাহিনী ও বিজিএমইএ কর্মকর্তাদের জন্য দুটি করে (মোট ৮টি) এসি বার্থ, নৌবাহিনী ও চট্টগ্রাম চেম্বারের জন্য একটি করে এসি বার্থ, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চারটি এসি বার্থ এবং ইমার্জেন্সি কোটায় ৪টি এসি বার্থ রাখা হয়।

এছাড়া সিন্ধায় ১০টি (ইমার্জেন্সি), শোভন চেয়ার ১০টি (ইমার্জেন্সি), শোভন চেয়ার ২০টি (প্রতিবন্ধী) আসন রাখা হয়। সুবর্ণ এক্সপ্রেসে বিচারপতিদের জন্য ৪টি, সংসদ সদস্যদের জন্য ৪টি, ভিআইপি ৮টি (স্নিগ্ধা), বিশেষ কোটা ১২টি (শোভন চেয়ার), ভিআইপি ৮টি (শোভন চেয়ার), বিশেষ কোটা ১২টি (শোভন চেয়ার) এবং প্রতিবন্ধী কোটায় শোভন চেয়ার শ্রেণির টিকিট সংরক্ষিত থাকে ২০টি।

পারাবত এক্সপ্রেসে প্রথম সিট (কেবিন) ৩টি (বিচারপতি), প্রথম সিট ৩টি (সংসদ সদস্য), প্রথম সিট ৩টি (ইমার্জেন্সি), শোভন চেয়ার ১০টি (ইমার্জেন্সি), শোভন ১০টি (প্রতিবন্ধী) কোটা রয়েছে। সিল্কসিটি এক্সপ্রেসে এসি বার্থ ৪টি (বিচারপতি), এসি বার্থ (সংসদ সদস্য), এসি বার্থ ৪টি (ইমার্জেন্সি কোটা), এসি চেয়ার ৪টি (মুক্তিযোদ্ধা), এসি চেয়ার ৪টি (ইমার্জেন্সি কোটা), শোভন চেয়ার ১০টি (প্রতিবন্ধী) কোটা রয়েছে। নীলসাগর এক্সপ্রেস এসি বার্থ ৪টি (বিচারপতি) এসি বার্থ ৪টি (সংসদ সদস্য), এসি চেয়ার ৮টি (ইমার্জেন্সি), শোভন চেয়ার ১০টি (প্রতিবন্ধী), রংপুর এক্সপ্রেস প্রথম শ্রেণি ৩টি (বিচারপতি), প্রথম শ্রেণি ৩টি (সংসদ সদস্য), প্রথম শ্রেণি ৩টি (ইমার্জেন্সি), শোভন চেয়ার ৮টি (ইমার্জেন্সি), শোভন ১০টি (প্রতিবন্ধী) কোটা রয়েছে। অন্যান্য ট্রেনে নিয়মিত কোটার পাশাপাশি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কোটা, সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জন্য টিকিট সংরক্ষণ করা থাকে।

রেলওয়ের বাণিজ্যিক বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, বিগত এক মাসেও কোনো সংসদ সদস্য কোনো টিকিট নিয়েছেন বলে আমাদের জানা নেই। একই চিত্র ভিআইপি অন্য কোটার ক্ষেত্রেও। তবে ঈদের সময় বা মাঝেমধ্যে এসব ভিআইপির পক্ষে কিছু লোক টিকিট নিয়ে থাকেন। সূত্র জানায়, এসব অবিক্রীত টিকিটের একটি অংশ বিক্রির নাম করে প্রিন্ট দিয়ে কালোবাজারে পাঠানো হয়। অন্য অংশের আসন নম্বরগুলো জানিয়ে দেয়া হয় ট্রেনে থাকা সংশ্লিষ্টদের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েক কর্মকর্তা জানান, ১০ দিন আগে এক-একটি আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট ছাড়া হয়। কিন্তু ভিআইপি নামক কোটার টিকিট প্রতিটি ট্রেন ছাড়ার ১২ ঘণ্টা আগ পর্যন্ত ব্লক করে রাখা হয়। ওই সময়ের মধ্যে সেসব ব্লক করা টিকিট অবিক্রীত থাকায় সরকারের লাখ লাখ টাকা লোকসান হয়।

কিন্তু টিকিট কালোবাজারি সিন্ডিকেট সদস্যদের লাভ ঠিকই হয়। কোটার নামে টিকিট ব্লক রেখে বাণিজ্য বন্ধে ২২ ডিসেম্বর প্রতিটি স্টেশন ও সংশ্লিষ্টদের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে। রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মিয়াজাহান স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সব ট্রেনের সব ধরনের টিকিট ব্লকিং (অটো কোটা ব্যতীত) বন্ধ করা হল। অটো কোটার টিকিট রেলওয়ে পরিচালক ট্রাফিক ও নিজ নিজ বিভাগের বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (ডিসিও) কর্তৃক কাটারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই অটো কোটা বন্ধ না হলে কালোবাজারির পথ খোলাই থাকবে। রেলওয়ের বাণিজ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, রেলওয়ে আইনে ভিআইপি কোটা নামে কোনো অপশন নেই। এটা কেবল সুবিধাভোগীদের জন্যই করা হয়েছে। এ কোটার বিরুদ্ধে কথা বললে চাকরি থাকবে না।

কোটার টিকিটের জন্য বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ে থাকা কর্মকর্তাদের নিজ নিজ গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হয়। কখনও কখনও ভিআইপিরা টিকিট নিয়ে নেয়, কিন্তু টাকা পরিশোধ করতে হয় রেলওয়ে কর্মকর্তাদের। কোটার টিকিট দিতে গিয়ে উনিশ থেকে বিশ হলেই গালমন্দও শুনতে হয়।

রেলওয়ে মহাপরিচালক মো. শামছুজ্জামান জানান, টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে রেলওয়ে কর্মচারী-কর্মকর্তা জড়িত থাকা খুবই দুঃখজনক। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ রয়েছে, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর ভিআইপি কোটা কিংবা যেসব ব্যক্তির জন্য কোটা পদ্ধতি রয়েছে, তা নিয়ে আমি কথা বলতে চাই না।

বিষয়টি মন্ত্রণালয় ভেবে দেখতে পারে। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোটার অনেক টিকিট বিক্রি হয় না। এতে রেলের নিশ্চয়ই লোকসান হয়। রেলপথ সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন বুধবার জানান, কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে মঙ্গলবার ১৫ জনকে বদলি করা হয়েছে। এর আগেও অনেককে তাৎক্ষণিক বদলি করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেয়া হবে। লোকবলস্বল্পতা থাকায় কৌশল নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। কোটার টিকিট বিষয়েও আলোচনা হচ্ছে- কী করে আরও স্বচ্ছতা আনা যায়।

যাদের বদলি করা হয়েছে : টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে সিলেট রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার আতাউর রহমানকে পশ্চিমাঞ্চল রেলে বদলি করা হয়েছে। একই সঙ্গে স্টেশনটির বুকিং সহকারী রেজাউর রহমান, মাসুদ সরকার, সুজন দত্ত, দুলাল মিয়া, স্বস্তি রঞ্জন দাশ, আরএনবি’র হাবিলদার জানে আলম, বুক কাম বেয়ারার আবু তাহেরকেও বদলি করা হয়েছে।

চাটমোহর স্টেশনের বুকিং সহকারী মীর পারভেজ আলী, খুলনা স্টেশনের বুকিং সহকারী মনিরুজ্জামান, মৌচাক স্টেশনের বুকিং সহকারী আবদুল হান্নান, বিরামপুর স্টেশনের বুকিং সহকারী মোর্শেদুল ইসলাম, বালাবাড়ী রেলওয়ে স্টেশন বুকিং সহকারী আবদুল কুদ্দুস, সলফ স্টেশনের আবদুল খালেক ও রাজশাহী স্টেশনে আরএনবির হাবিলদার কাউসার আলীকে পূর্বাঞ্চল রেলে বদলি করা হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর