,

ভাঙন নেই তবুও লাখ লাখ টাকা বরাদ্দ!

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি: মনে আছে ২০১৭ সালের হাওরডুবির কথা? চারদিকে হাহাকার, কান্না, আর ঋণের বোঝা মাথা নিয়ে দিনের পর দিন না খেয়ে কাটিয়ে দেয়া। আবার সব হারিয়ে বাড়িছাড়াও হন অনেক মানুষ।

সেবছর হাওর পাড়ের মানুষকে এক নজর দেখতে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে এসেছিলেন। আশ্বাস দিয়েছিলেন হাওর পাড়ের কৃষকদের ধান রক্ষা করার জন্য তিনি সব রকমের চেষ্টা করবেন।

তারপর থেকে হাওররক্ষা বাঁধ নির্মাণে বড় অংকের টাকা প্রতি বছর বরাদ্দ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এমনকি হাওরের বাঁধ ঠিকমতো নির্মাণ হচ্ছে কি না সেজন্য সার্বক্ষণিক খোঁজ খবরও রাখেন। ফলে ২০১৭ সালের পর সুনামগঞ্জে এখন পর্যন্ত আর হাওরের ধান তলিয়ে যায়নি।

কিন্তু হাওররক্ষা বাঁধের সেই কাজে কিছুটা ভিন্নতা এসেছে। যে পিআইসিতে কাজ বেশি সেই পিআইসিতে বরাদ্দ কম আবার কোথাও কোথাও কাজ কম, বরাদ্দ বেশি।

যেমন সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার মিনি পাগনা হাওরের ৩টি পিআইসিতে গত মৌসুমের চেয়েও এই মৌসুমে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। যা এখন হাওরে রীতিমতো মতো আলোচনার ঝড় তুলেছে।

কৃষকরা জানান, সরকার উদ্যোগ নিয়েছিল যার জায়গা জমি আছে তাকে নিয়ে পিআইসি গঠন করা হবে, কিন্তু যাদের জায়গা জমি আছে তারা পিআইসিতে ঢুকতে পারেন না। দলীয় প্রভাব যাদের আছে তারাই পিআইসিতে ঢুকতে পারেন। সরকার যদি ওইদিকে একটু নজর দিত তাহলে আমরা প্রকৃত কৃষকরা পিআইসিতে ঢুকতে পারতাম।

দলীয় নেতাদের নিয়ে পিআইসি গঠন করা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন অনেক কৃষক। তবে দায়িত্বশীলরা এই অভিযোগ মানতে নারাজ।

রোববার (৩১ জানুয়ারি) জামালগঞ্জ উপজেলার ফেনারবাঁক ইউনিয়নের মিনি পাগনা হাওরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাওরের ধানরক্ষা করার জন্য ৩ পিআইসিতে গতবারের তুলনায় এবছর হাওররক্ষা বাঁধের জন্য বেশি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে যার একটিতেও বড় কোনো ভাঙন নেই।

তায়েবনগর গ্রাম থেকে শুরু হয়ে মিনি পাগনা ঘুরে যশমন্তপুর এসে যুক্ত হওয়া তিন বাঁধের অধিকাংশ ক্ষেত্রে এখনও অক্ষত আছে পুরোনো মাটি। ওই তিনটি বাঁধ দেখলেই বোঝা যায় যেন সেটি একটি সড়ক। গত মৌসুমের পুরোনো বাঁধের অনেকাংশে অল্পসংখ্যক মাটি ফেললেই পুরোদস্তুর বাঁধ হয়ে যাবে এমনটাই বলেছেন স্থানীয়রা কৃষকরা। তবু তিন বাঁধে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে গত বছর থেকে প্রায় দ্বিগুণ।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে মিনি পাগনা হাওরের ১৮ নম্বর (বর্তমান ১নং) পিআইসির অনুকূলে বরাদ্দ ছিল ১২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা, ১৯ নম্বর (বর্তমান ২নং) পিআইসিতে ৫ লাখ ২৭ হাজার এবং ২০ নম্বর (বর্তমান ৩নং) পিআইসিতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল ৮ লাখ ৪২ হাজার টাকা। একই হাওরে ২০২০-২০২১ চলতি অর্থবছরে ১ নম্বর পিআইসির অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২০ লাখ ৮ হাজার টাকা, ২ নম্বর পিআইসিতে ১৭ লাখ ৫৮ হাজার টাকা এবং ৩ নম্বর পিআইসিতে ১৮ লাখ ২৮ হাজার টাকা। গত মৌসুমের তুলনায় এ মৌসুমে বরাদ্দ বেশি হওয়ায় হাওরপাড়ের কৃষকরা বলছেন বাঁধ ব্যবসার জন্যই এটি করা হয়েছে।

গত বছরের পিআইসি সভাপতি ও রামপুর গ্রামের কৃষক মো. আমান উল্লাহ আমান জাগো নিউজকে বলেন, তায়েবনগর থেকে যে বাঁধটা শুরু হয়েছে গত বছর সে বাঁধের কাজ আমি করেছি। তাতে বরাদ্দ ছিল ৯ লাখের কিছু উপরে। কিন্তু এ বছর তাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৮ লাখের বেশি। গত বছর এ বাঁধে কয়েকটা ভাঙন ছিল, এ বছর কোনো ভাঙন নেই। তারপরও বরাদ্দ প্রায় দ্বিগুণ। যদি ওই বাঁধগুলোতে ৫ ফুট উচ্চতায় মাটি ফেলা হয় তারপরও এত টাকা লাগবে না বলে জানিয়েছেন তিনি।

ফেনারবাঁক ইউনিয়নের হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি গজারিয়া গ্রামের কৃষক মো. শাহাব উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, গত বছর এই বাঁধগুলোতে বরাদ্দ ছিল কম, কাজ ছিল বেশি। এ বছর বরাদ্দ বেশি, কাজ কম। মিনি পাগনায় যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তাতে আমার ধারণা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এটা হয়েছে। এই তিন বাঁধে এত বেশি বরাদ্দের কোনো প্রয়োজন নেই। এখানে বড় কোনো ভাঙন নেই। তারপরও মেজারমেন্ট করে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তাতে ভিন্ন কিছুর আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

এদিকে কম বরাদ্দ হওয়ায় বাঁধের কাজ থেকে অব্যাহতি চাওয়া পাগনা হাওরের ৫ নম্বর পিআইসি সভাপতি মো. আব্দুল মন্নাফ জাগো নিউজকে বলেন, রামপুর থেকে জামলাবাজ পর্যন্ত কাজ দেওয়া হয়েছে আমাকে। যেখানে ভাঙন আছে ৪ থেকে ৫টি। সেখানে বরাদ্দ মাত্র ৬ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। নিজের খেত বিক্রি করে তো আর কাজ করতে পারব না। তাই অব্যাহতি চেয়েছি।

মিনি পাগনার ৩ নম্বর পিআইসির সভাপতি শংকর চন্দ্র দাস বলেন, আব্দুল্লাহপুর তায়েবনগরের মাঝখানের সামান্য অংশ, তায়েবনগরের মাথা থেকে বাকি অংশ কাজ করার জন্য আমাকে বলা হয়েছে। এজন্য বরাদ্দ সাড়ে ১৮ লাখ টাকা। বরাদ্দ কম না বেশি, এই ব্যাপারে কিছু বলতে পারেননি তিনি।

জগন্নাথপুর উপজেলা হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অঞ্জন পুরকায়স্থ জানিয়েছেন, পাউবোর যারা মেজারমেন্ট করেছেন, তারা স্থানীয় লোকজনকে এতে সম্পৃক্ত না করায় এই ত্রুটি হয়েছে। অনেকটা জেনেশুনেই এই কাজগুলো করা হচ্ছে। মেজারমেন্টে বোঝানো হচ্ছে বেশি মাটি লাগে, আসলে কিন্তু বেশি মাটি লাগছে না। যেখানে কোনো ভাঙন নেই, সেখানে এত টাকা বরাদ্দের কোনো প্রয়োজন নাই।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. রেজাউল কবীর বলেন, এখানকার বাঁধগুলো নিচু অবস্থায় আছে এবং স্লোব কমে গেছে। গতবার বরাদ্দ কমের কারণে কাজ করা হয়নি। এ বছর ওই অংশগুলোতে কাজ করা হচ্ছে। ফলে বরাদ্দ বেড়েছে। মাটি যেভাবে আছে মেজারমেন্ট অনুযায়ী সেভাবেই ইস্টিমেট প্রস্তুত করা হয়েছে। ডিজাইন লেবেল অনুযায়ীই বাঁধে মাটি পড়বে।

এই বিভাগের আরও খবর