বিডিনিউজ ১০ ডেস্ক: ঢাকাসহ সারাদেশের বাজারগুলো থেকে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য-সংক্রান্ত ১৯০টি নমুনা পরীক্ষা করে ক্ষতিকর উপাদান পেয়েছে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলো। বিশেষ করে কাঁচা তরল দুধের ৯৬টি নমুনার মধ্যে ৯৩টিতেই ক্ষতিকর উপাদান পাওয়া গেছে। এগুলো ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। গতকাল সংস্থাটি হাইকোর্টে এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন দাখিল করে। আদালত দায়ীদের চিহ্নিত করে তালিকা প্রকাশ ও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন।
বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি একেএম হাফিজুল আলম সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে দুধ-দইয়ে অণুজীব, কীটনাশক ও সিসার বিষয়ে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষসহ সংশ্নিষ্ট সংস্থাগুলোর নেওয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে অবহিত করে গতকাল বুধবার এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। ন্যাশনাল ফুড সেফটি অথরিটির পক্ষে প্রতিবেদনটি আদালতে দাখিল করেন আইনজীবী মোহাম্মদ ফরিদুল ইসলাম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হেলেনা বেগম চায়না। দুদকের পক্ষে আইনজীবী মো. খুরশিদ আলম খান উপস্থিত ছিলেন।
দুধে বিষাক্ত বস্তু মেশানোর সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দিয়ে এ বিষয়ে শুনানির জন্য আগামী ১৫ মে দিন ধার্য করেন আদালত। বিএসটিআইর মহাপরিচালকের পক্ষে আদালতে ওকালতনামা দাখিল করা হয়। আদালতের নির্দেশনার পর আমিনউদ্দিন মানিক বলেন, দুধে বিষাক্ত বস্তু মেশানোর সঙ্গে কারা এবং কোন প্রতিষ্ঠান জড়িত তাদের নামের তালিকা দাখিল না করায় আদালত অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে আগামী ১৫ মের মধ্যে জড়িতদের নামের তালিকাসহ পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন আকারে আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছে।
উচ্চ আদালতের নির্দেশে বিএফএসএর গঠিত কমিটি গত ২৯ এপ্রিল প্রাথমিক প্রতিবেদন তৈরি করে। ওই প্রতিবেদনে ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরি পরিচালিত গবেষণার ফলাফলের সারসংক্ষেপ অনুযায়ী, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ১৮টি স্থান থেকে ১৯০টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এই নমুনা বিএসটিআই, বিএফএসএ, এফএসএসএআই, কোডেক্স ও ইএসইএ সম্মিলিতভাবে মান মূল্যায়ন করে প্রতিবেদন দেয়। এই প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হয়। এই প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হলো-
৯৬টি কাঁচা তরল দুধের নমুনা :এর মধ্যে অণুজৈবিক বিশ্নেষণ রিপোর্ট অনুযায়ী, ৯৩টি নমুনাতে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার টোটাল প্লেট কাউন্ট (টিপিসি) ও কলিফরম কাউন্ট ক্ষতিকর মাত্রায় বিদ্যমান আছে। একটি নমুনায় সালমোনেলা পাওয়া গেছে। রাসায়নিক বিশ্নেষণ অনুযায়ী ৫টি নমুনাতে সিসা, ৩টিতে আফলাটক্সিন, ১০টিতে টেট্রাসাইক্লিং, একটিতে সিপ্রোফ্লক্সাসিন এবং ৯টিতে পেস্টিসাইট (অ্যান্ডোসালফান) ক্ষতিকর মাত্রায় পাওয়া যায়।
প্যাকেটজাত তরল দুধের ৩১টি নমুনা :দেশি ২১টি এবং আমদানি করা ১০টি নমুনার মধ্যে ১৭টি দেশি দুধের নমুনাতে টিপিসি ও কলিফরম কাউন্ট, ১৪টিতে মোল্ডস এবং আমদানি করা তরল দুধের একটি নমুনাতে কলিফরম কাউন্ট ক্ষতিকর মাত্রায় রয়েছে। রাসায়নিক বিশ্নেষণে দেখা যায়, দেশি দুধের একটি নমুনাতে আফলাটক্সিন, ৬টিতে টেট্রাসাইক্লিং এবং আমদানি দুধের তিনটিতে টেট্রাসাইক্লিং ক্ষতিকর মাত্রায় রয়েছে।
দইয়ের ৩৩টি নমুনা :বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা দইয়ের ৩৩টি নমুনার মধ্যে ১৭টিতে টিপিসি, ৬টিতে কলিফরম কাউন্ট, ১৭টিতে ইস্ট মোল্ড এবং একটিতে সিসা ক্ষতিকর মাত্রায় আছে।
পশুখাদ্যের ৩০টি নমুনা :এর মধ্যে ১৬টিতে ক্রোমিয়াম, ৪টিতে আফলাটক্সিন, ২২টিতে টেট্রাসাইক্লিং, ২৬টিতে এনরোফ্লক্সাসিন, ৩০টিতে সিফরোফ্লক্সাসিন এবং ২টিতে পেস্টিসাইট (অ্যান্ডোসালফান) ক্ষতিকর মাত্রায় পাওয়া গেছে।
হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশ অনুসারে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. মাহবুব কবিরকে আহ্বায়ক করে ১৬ সদস্যের এ কমিটি গঠন করে বিএফএসএ, যা আদালতকেও অবহিত করা হয়েছিল। এই কমিটি গতকাল আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছে। কমিটি একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছে বলেও আদালতকে জানানো হয়। কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, গবেষণার ফলাফল তথ্য প্রতিবেদন পর্যালোচনা ও সমস্যা নিরূপণ করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। একই সঙ্গে নমুনা উৎসমূল অনুসন্ধান, নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে নির্দিষ্ট সুপারিশ করবে এই কমিটি। কমিটি এ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ৪ সপ্তাহ সময় নিয়ে কাজ করতে ৩টি ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করেছে। এগুলো হলো- গত ২৪ এপ্রিল থেকে আগামী ২২ মের মধ্যে কাঁচা তরল ও পাস্তুরিত দুধের নমুনা সংগ্রহ, গবেষণাগারে পরীক্ষা ও ফলাফল পর্যালোচনা করা, পশুখাদ্যের নমুনা সংগ্রহ এবং গবেষণাগারে পরীক্ষা ও ফলাফল পর্যালোচনা করে ২৩ মে থেকে ২২ জুনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল। এ ছাড়া প্রাথমিক উৎপাদন ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ, ফলাফলের তুলনামূলক বিশ্নেষণ এবং যথাযথ সুপারিশ প্রণয়ন করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেবে ২৩ মে থেকে ২২ জুলাইয়ের মধ্যে। কমিটির আহ্বায়ক স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য ও কমিটির আহ্বায়ক মো. মাহবুব কবীর বলেন, আদালতের নির্দেশনার কপি হাতে পেলে সে অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সংস্থার পরিচালক ড. সাহদেব চন্দ্র সাহা বলেন, দেশের বাজারে প্রচলিত বিএসটিআই অনুমোদিত পাস্তুরিত দুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে পাস্তুরিত দুধের মোড়কে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিচে সংরক্ষণ করার জন্য সতর্ক করা হয়েছে। একই সঙ্গে পাস্তুরিত দুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নবায়ন ও নতুন লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে সতর্কবাণী সংযোজনকে বাধ্যতামূলক শর্ত হিসেবে আরোপ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইতিমধ্যে কোম্পানিগুলো এই সতর্কতা অনুসরণ শুরু করেছে। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী অন্যান্য বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যে ভেজাল ও নিম্নমানের বিষয়ে উচ্চ আদালত ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছেন। এখন সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী তৎপর হয়। এর সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ সচেতন হলে সমস্যার সমাধান হবে। তিনি বলেন, মাত্রাতিরিক্ত কেমিক্যাল, সিসা, অ্যান্টিবায়োটিকসহ সব উপাদান ক্ষতিকারক। এই ক্ষতিকারক পদার্থ যেন কোনো পণ্যে না মেশানো হয়। আমরা এসব সমস্যার সমাধান চাই। দুগ্ধজাত পণ্য আমদানিকারক ও উৎপাদককে আরও সচেতন হতে হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। যাতে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি না হয়। নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কঠোর হলে ভেজাল ও নিম্নমানের পণ্য বিক্রির প্রবণতা কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, সরকারের জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগারের (এনএফএসএল) এক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে গত ১০ ফেব্রুয়ারি সংবাদ প্রকাশিত হয়। পরদিন জনস্বার্থে প্রতিবেদনটি আদালতের নজরে আনেন একজন আইনজীবী। এদিন ঢাকাসহ সারাদেশের বাজারগুলোতে দুধ ও দুগ্ধজাতীয় খাবারে কী পরিমাণ ভেজাল (ব্যাকটেরিয়া, কীটনাশক এবং সিসা) মেশানো হয়েছে তা পরীক্ষা করে জরিপ প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। সে সময় আদালত উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছিলেন, খাদ্যে ভেজাল মেশানোর কারণে মানুষের কিডনি ও লিভার নষ্ট এবং ক্যানসার হচ্ছে। খাদ্যে ভেজাল মেশানো ‘বড় ধরনের দুর্নীতি’ (সিরিয়াস করাপশন)। একই সঙ্গে দুধের সঙ্গে সিসা মিশ্রণকারীদের শাস্তির আওতায় আনতে ব্যর্থতা কেন বেআইনি হবে না জানতে চেয়ে রুল জারি করেন আদালত। পাশাপাশি দুধ ও দুগ্ধজাতীয় খাবারে ভেজাল মেশানোর সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি (মৃত্যুদণ্ড) দেওয়ার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়। তখন চার সপ্তাহের মধ্যে খাদ্য সচিব, স্বাস্থ্য সচিব, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সচিব, কৃষি সচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, কেন্দ্রীয় নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটি, দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিএসটিআই চেয়ারম্যানকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।
মানহীন দই বিক্রি :বিএসটিআইয়ের মামলা- এদিকে গতকাল অভিযান চালিয়ে নামিদামি প্রতিষ্ঠানে মানহীন ভেজাল দই বিক্রির প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। এ অপরাধে সংস্থাটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। সংস্থাটির সহকারী পরিচালক তালাত মাহমুদ ও খালেদ রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানে বিএসটিআইর লাইসেন্স ছাড়া পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করা এবং ওজন ও পরিমাপে কারচুপির অপরাধে ১৭টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। জাতীয় মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে।
সংস্থাটি জানায়, বিএসটিআই লাইসেন্স ছাড়া ফার্মান্টেড মিল্ক্ক বা দই বিক্রি করছে অনেক প্রতিষ্ঠান। এসব দই মানহীন। গতকাল অভিযানে সংস্থার লাইসেন্স ছাড়া নিম্নমানের দই বিক্রির অপরাধে রাজধানীর পুরান ঢাকার স্বামীবাগ এলাকার ভগবৎ সাহা শংখনীল রোডে মোহনচাঁদ সুইটসের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ওই এলাকায় মধু ও টুথ পাউডার বিক্রির অপরাধে শক্তি ঔষধালয়ের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এক অভিযানে মানহীন দই বিক্রির অপরাধে রামপুরায় মুসলিম সুইটস, শান্তিবাগে নিউ মুসলিম মিষ্টান্ন ভাণ্ডার অ্যান্ড বেকারি এবং মালিবাগে গোল্ডেন সুইটসের বিরুদ্ধে এ সময় নিয়মিত মামলা করা হয়। এছাড়া বরিশালে ১২টি মিষ্টি ও দই এবং ফলের দোকানে অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে ৪টি ফলের দোকানে আঙুর ও আমে ফরমালিন পাওয়ায় সেগুলো ধ্বংস করা হয়।
বিএসটিআইর পরিচালক (সিএম) এস এম ইসহাক আলী বলেন, বিএসটিআই খাদ্যের মান নিশ্চিত করতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। রমজান মাসের অভিযানেও দুগ্ধজাত পণ্যের ভেজাল তদারকি করা হচ্ছে। এই অভিযানে নিয়মিত অপরাধীদের বিরুদ্ধে জরিমানা, শাস্তি ও মামলা করা হচ্ছে।