,

চাই সবার উন্নত জীবন আর নৌকায় ভোট

ময়মনসিংহে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ময়মনসিংহ প্রতিনিধি: জনতার মহাসমুদ্রে পরিণত হওয়া ময়মনসিংহের জনসভায় জনতার কাছ থেকে আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে ভোট দেওয়ার ওয়াদা নিলেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি তাঁর শাসনামলে বাংলাদেশের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে বলেন, ‘দেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে। আজকে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। সমাজের সকল স্তরে উন্নয়ন হচ্ছে। উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত রাখতে হলে আবারও সবাইকে নৌকা মার্কায় ভোট দিতে হবে।’

গতকাল শুক্রবার বিকেলে ময়মনসিংহ সার্কিট হাউস মাঠে স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।

জনসভার আগে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের নিয়ে ময়মনসিংহ বিভাগের ১০৩টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন এবং বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার, বিভাগীয় স্টেডিয়াম ও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ খননসহ ৯৩টি প্রকল্পের ভিত্তিফলক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী। পরে জনসভায় দেওয়া বক্তব্যে এসব প্রকল্পের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি ময়মনসিংহকে বিভাগ করেছি। আজ ময়মনসিংহ বিভাগের জন্য অনেক উপহার নিয়ে হাজির হয়েছি।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘২০৪১ সালে বাংলাদেশ হবে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ। এ জন্য দরকার আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকা। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে নৌকা মার্কায় ভোট  চাই।’ জনসভায় উপস্থিত সবার উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা হাত তুলে ওয়াদা করেন।’ এ সময় সবাই একসঙ্গে হাত তুলে ‘নৌকা, নৌকা’ স্লোগানে ভোট দেওয়ার ওয়াদা করেন। এরপর তাদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘আমার কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। আপনাদের সেবা করা আমার কাজ। সকলে সুন্দরভাবে বাঁচবেন, উন্নত জীবন পাবেন, সেটা আমরা চাই।’

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘আগামী দিনে নির্বাচন। পূর্বে যেভাবে নৌকায় ভোট দিয়েছিলেন, আগামী দিনেও নৌকায় ভোট দিয়ে দারিদ্র্যসীমা পাঁচ থেকে ছয় ভাগে নামাতে হবে। সে জন্য আপনাদের সহযোগিতা চাই।’

তিনি বলেন, ‘বাংলার মানুষ যেন ভাত পায়, কাজ পায়, সে জন্য সকল উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। কেউ গৃহহারা থাকবে না। খুলনাকে ভিক্ষুক মুক্ত করা হয়েছে। ময়মনসিংহকেও ভিক্ষুক মুক্ত করা হবে। যাদের শক্তি আছে, তারা কাজ করবে। যাদের কাজ করার সামর্থ্য নাই, সরকার তাদের ভাতা দেবে।’

বক্তব্যে জাতির জনককে স্মরণ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ‘সদ্য স্বাধীন একটি দেশকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালে নির্মমভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়। বাবা-মা-ভাই, সবাইকে হারিয়েছি। মানুষ তার আপনজনকে হত্যার বিচার চাইতে পারে, আমাদের সেই বিচার চাওয়ার সুযোগও দেওয়া হয়নি। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধ করতে চেয়েছিল জিয়াউর রহমান।’

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু ২০০১ সালে ষড়যন্ত্র করে আমাদের ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হলো না। সে সময় ক্ষমতায় এসে বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হত্যা-নির্যাতন করে।’

বিএনপির শাসনামলের নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ঈদের পর দিন ময়মনসিংহের চারটি সিনেমা হলে বোমা ফুটল। নিহত ১৮ জন; প্রায় ২০০ জন আহত হয়। সেই সময় আমাদের আওয়ামী লীগ নেতা মতিউর রহমান ও জালাল উদ্দিনসহ অনেককে গ্রেপ্তার করে অত্যাচার করেছে। এই এলাকার বিভিন্ন অঞ্চলের নারীদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন করেছে, গণধর্ষণ করেছে, ’৭১-এর পাক হানাদারদের মতো। আমাদের যুবলীগ নেতা কামরুজ্জামানের হাতের ১০টি আঙুল কেটে দিয়েছিল। বসতবাড়ি দখল করে ওই গফরগাঁওয়ে রাতারাতি পুকুর করা হয়েছিল।’

সরকারপ্রধান বলেন, ‘ওই সময় দেশে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, খুন, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছিল। ওই সময় সরকারে ছিল হাওয়া ভবন। ওই হাওয়া ভবনের খাওয়া মেটাতে গিয়ে দেশের কোনো উন্নয়ন হয়নি, সব অর্থপাচার হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ কাউকে নির্যাতন করে না, আওয়ামী লীগ দেশের উন্নয়ন করে।’

তিনি বলেন, ‘২০০৮ সালে দেশের জনগণ আওয়ামী লীগকে নৌকা মার্কায় ভোট দেয়। আর সেই ভোটে নির্বাচিত হয়ে আমরা সরকার গঠন করি। ২০০৮ থেকে আজ ২০১৮, প্রায় ১০ বছর আমরা আপনাদের সার্বিক উন্নয়নে ব্যাপক কাজ করেছি। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করছি।’

শেখ হাসিনা তাঁর বক্তব্যে তরুণ ও যুবসমাজকে দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি বলে উল্লেখ করে তাদের জন্য নেওয়া সরকারের পদক্ষেপগুলো তুলে ধরেন। একই সঙ্গে ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল যে আজ দেশবাসী পাচ্ছে, তাও বক্তব্যে তুলে ধরেন তিনি।

সমাজের সব গোষ্ঠীর উন্নয়নে সরকার কাজ করছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা বিধবা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতা দিচ্ছি। মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ সম্মানী ভাতা দিচ্ছি। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ভাতার ব্যবস্থা করেছি। সমাজে কেউ বাদ থাকবে না সবার উন্নয়ন হবে—এই চিন্তা থেকেই রাষ্ট্র পরিচালনা করি। আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছি। এটা আমরা অর্জন করতে পেরেছি আপনারা নৌকায় ভোট দিয়েছেন বলে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন ‘ময়মনসিংহে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হবে। এতে বিপুলসংখ্যক লোকজনের কর্মের সংস্থান হবে।’ বক্তব্যের শেষপর্যায়ে দেশের মানুষের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন জানিয়ে কবির ভাষায় শেখ হাসিনা বলেন, ‘নিঃস্ব আমি, রিক্ত আমি, দেবার কিছু নাই/আছে শুধু ভালোবাসা, দিয়ে গেলাম তাই।’

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট জহিরুল হক খোকার সভাপতিত্বে জনসভায় আরো বক্তব্য দেন দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, ধর্মমন্ত্রী আলহাজ অধ্যক্ষ মতিউর রহমান, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দীপু মনি, সাংগঠনিক সম্পাদক মেজবাহ উদ্দিন সিরাজ, মির্জা আজম, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল, সংসদ সদস্য নাজিম উদ্দিন আহম্মেদ, ময়মনসিংহ-১০ (গফরগাঁও) আসনের সংসদ সদস্য ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল, সংসদ সদস্য শরীফ আহম্মেদ, মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি এহতেশামুল আলম, মহানগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মোহিত উর রহমান শান্ত, ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক ইকরামুল হক টিটু প্রমুখ।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের আগে তাঁর হাতে নবগঠিত ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের চাবি তোলে দেন যথাক্রমে সিটি করপোরেশনের প্রশাসক ইকরামুল হক টিটু, এহতেশামুল আলম এবং শরীফ আহম্মেদ এমপি।

প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা প্রকল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ময়মনসিংহ রেঞ্জ ডিআইজির কার্যালয়, ময়মনসিংহ বিভাগীয় স্টেডিয়াম, নভোথিয়েটার, ব্রহ্মপুত্র নদ খনন, সিভিল সার্জনের কার্যালয়, জেলা সমাজসেবা কমপ্লেক্স, বাকৃবি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন, জামালপুর-চেচুয়া-মুক্তাগাছা সড়কের উন্নয়ন, ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা সড়কের উন্নয়ন, বানার সেতু, বিআরটিসি ট্রেনিং সেন্টার, ময়মনসিংহ মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, আনন্দমোহন কলেজের ১০ তলা প্রশাসনিক ভবন, ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ড, শিক্ষা প্রকৌশল ভবন, তারাকান্দা ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল, সুতিয়াখালী ৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প, ময়মনসিংহ হাইটেক পার্কসহ বিভিন্ন উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ও জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণ ইত্যাদি।

বিকেল ৪টায় জনসভাস্থলে প্রধানমন্ত্রী আসার আগেই সার্কিট হাউসের বিশাল মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। নিরাপত্তাজনিত কড়াকড়ি থাকায় মাঠে প্রবেশে অল্প কয়েকটি প্রবেশ পথ থাকায় বিপুলসংখ্যক নারী-পুরুষ মাঠেই ঢুকতে পারেনি। অনেকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বক্তব্য শুনেছে। প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে কেন্দ্র করে পুরো শহরে ছিল সাজসাজ রব। সকাল ১১টা থেকেই বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে হাজারো নেতাকর্মী নৌকা প্রতীক ও বাজনা সহকারে সার্কিট হাউস মাঠে উপস্থিত হয়। জেলা উপজেলার বিভিন্ন নেতা তাঁদের বিশাল বিশাল মিছিল নিয়ে শহরের সড়ক দিয়ে হেঁটে জনসভাস্থলে পৌঁছান। তবে জনসভাস্থলে কোনো নেতার ছবিসংবলিত ফেস্টুন নিয়ে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, এটা স্মরণকালের সবচেয়ে বড় সমাবেশ।

এই বিভাগের আরও খবর