নিজস্ব প্রতিবেদক: স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় নেতা শওকত আলী (দিদার) হত্যা মামলাকে পুঁজি করে কাশিয়ানী থানার ওসি মো. শফিউদ্দিন খান বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। তিনি তার পছন্দের উপ-পরিদর্শক (এসআই) হারুন অর রশিদকে দিয়ে করছেন ‘মামলাবাণিজ্য’। আসামি ‘ধরা-ছাড়া’ খেলা করে হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। নিরীহ-নিরপরাধ মানুষও তার কাছে জিম্মি হয়ে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে রেহাই পাচ্ছেন। ওসি-এসআইর দাবি পূরণ না হলে নিরীহ মানুষকেও বিভিন্ন মামলায় ‘অজ্ঞাত আসামি’ করে হয়রানি করার অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছাত্র-জনতা গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর কাশিয়ানী উপজেলা আ.লীগ ও সহযোগি সংগঠনের নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে চলে যায়। এলাকায় থাকা তৃণমূল আওয়ামী লীগের ‘বিত্তশালী’ নেতাকর্মীদের টার্গেট করে বাড়িতে পুলিশ পাঠিয়ে ‘মহড়া’ দেওয়া হয়। এরপর থানায় গিয়ে ওসির সাথে যোগাযোগ করতে বলা হয়। ‘এজাহারে’ নাম না থাকলেও শুধু আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক হওয়ায় দাবি করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা। ওসি টাকা পেলেই মেলে বাড়িতে ঘুমানো ও এলাকায় থাকার নিশ্চয়তা। এভাবেই দেন-দরবারে আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে ওসির গড়ে উঠছে গভীর সখ্যতা। ওসির ‘আশকারায়’ অনেক আওয়ামী লীগ নেতা অধরা। অথচ রাজনীতির সাথে জড়িত না থাকা ব্যক্তিরাও হচ্ছেন মামলার ‘অজ্ঞাত আসামি’। ঘুষবাণিজ্য থেকে রেহাই পাচ্ছে না দিনমজুরও। এমনকি ওসির কালো থাবা থেকে রক্ষা পায়নি বিএনপি নেতারাও।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, হাসিনা সরকার পতনের পর কাশিয়ানী থানার সকল কর্মকর্তার বদলি হলেও; এসআই হারুন অর রশিদের এখনও বদলি হয়নি। ২০২২ সালে আ.লীগ সরকারের শাসনামলে কাশিয়ানী থানায় যোগদান করেন তিনি। তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি ও গ্রেফতারে বেশ ভূমিকা ছিল এসআই হারুনের। দীর্ঘদিন একই কর্মস্থলে থাকায় উপজেলার আওয়ামীপন্থী লোকজনের সাথে তার গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এসআই হারুন এখনও কাশিয়ানী থানায় বহাল তবিয়তে।
ওসি শফিউদ্দিন শুধু অর্থই ঘুষ নেন না। হাঁস-মুরগী, মাছ-মাংস, দুধ, স্বর্ণ-গহনাসহ বিভিন্ন উপকরণ, এমনকি পায়ের জুতাও উপঢৌকন নেন। উৎকোচ একবার নিয়ে ক্ষ্যান্ত হন না, একই ব্যক্তির নিকট থেকে দফায় দফায় ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
এমন ভুক্তভোগী কাশিয়ানী সদর ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য জাকির হোসেন। হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন মামলায় আসামি করার ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে ২লাখ টাকা হাতিয়ে নেন ওসি। শুধু তাই নয়, ৫০ হাজার টাকার মাছও ঘুষ নিয়েছেন। গত ২৩ মার্চ ওই ইউপি সদস্যকে আবারও মামলার ভয় দেখিয়ে ওসি শফিউদ্দিন ১ লাখ ৬৬ হাজার টাকার এসি (শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র) জোরপূর্বক কিনিয়ে নিয়েছেন। যা তিনি নিজে গোপালগঞ্জ এলজির শোরুমে গিয়ে পছন্দ করে নিয়েছেন এবং থানায় তার ব্যক্তিগত কক্ষে লাগিয়েছেন। ভুক্তভোগী জাকির হোসেন বলেন, ‘মামলার ভয় দেখিয়ে ওসি আমার কাছ থেকে কয়েক দফা টাকা নিয়েছেন। আবার একটা এসি দাবি করেন। কাছে নগদ টাকা না থাকায় নিরুপায় হয়ে কিস্তিতে কিনে দিয়েছি। ঈদে ছেলে-মেয়েদের নতুন জামা-কাপড় পর্যন্ত কিনে দিতে পারিনি। এতেও ক্ষ্যান্ত হননি ওসি, ঈদের আগের দিন আবারও হটসঅ্যাপ নম্বরে কল করে কিছু টাকা চান তিনি।’
সম্প্রতি, এসি কিনে দিতে ইউপি সদস্যের সাথে ওসির কথোপকথনের একটি কলরেকর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যা নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একই এলাকার এক ভুক্তভোগী জানান, হাট-বাজার ইজারার দরপত্র সিডিউল কেনায় এবং তা প্রত্যাহারের জন্য ওসি ওই ভুক্তভোগীর মুঠোফোনে কল করে হুমকি দেন। বিপদে পড়ার ভয়ে তিনি ওসিকে ১ লাখ টাকা ঘুষ দেন। এরপরই পাল্টে যায় ওসির সুর। ওই ভুক্তভোগীকে এলাকায় থাকতে এবং সহযোগিতার আশ^াস দেন ওসি।
ভাটিয়াপাড়া বাজারের একাধিক ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে ওসি শফিউদ্দিনের গ্রেফতার ও মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে ঘুষবাণিজ্যের চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। শতাধিক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ওসি শফিউদ্দিন। কিন্তু মামলার ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জঙ্গলমুকুন্দপুর গ্রামের বালু ব্যবসায়ী দিহান শেখের সাথে ওসি শফিউদ্দিনের গড়ে উঠেছে গভীর সখ্যতা। সন্ধ্যার পরেই ভাটিয়াপাড়া ওই যুবকের আস্তানায় চলে ওসি শফিউদ্দিনের আড্ডা। তবে ওখানে ওসির ‘অবাধ যাতায়াত’ স্থানীয়দের নজরে পড়ায় এখন হোটেল-রেস্তোরায় চলে আড্ডা। ওসির মদদে বেপরোয়া দিহান। এলাকার বালু ব্যবসার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ, চাঁদা আদায়, পুলিশ দিয়ে লোকজনকে ‘ধরা-ছাড়া’ সবই করছেন দিহান। তার দেওয়া তথ্য ও নির্দেশেই কাজ করেন ওসি। দেন-দরবার করে দেন দিহান। ওসি বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কথা না শুনলেও দিহানের কথায় সবই করেন। অভিযোগ রয়েছে, দিহানের নির্দেশেই ভাটিয়াপাড়ার বাসিন্দা সাবেক ইউপি সদস্য ষাটোর্ধ্ব আব্দুর ছত্তার শেখকে গ্রেফতার করে অজ্ঞাত আসামি হিসেবে জেলহাজতে পাঠিয়েছেন ওসি। এলাকার অধিপত্য নিয়ে ছত্তার শেখের সাথে দীর্ঘদিন ধরে দিহানের পরিবারের দ্বন্দ্ব চলছিল। পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তার নিরপরাধ ছেলেও। এভাবেই দিহান ওই এলাকায় ‘আতঙ্ক’ হয়ে উঠেছে। শত শত মানুষকে হয়রানি করে আসছে বলে একাধিক অভিযোগ রয়েছে। দিহানকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
গত ১৫ মার্চ বিকেলে উপজেলার বরাশুর গ্রামের ভেকু চালক রবিউল মিয়াকে অজ্ঞাত একটি নম্বর থেকে কল করে ওসির সাথে দেখা করার কথা বলে থানায় ডেকে নেওয়া হয়। রবিউল ওসির কক্ষে গিয়ে তার পরিচয় দিতেই ওসি তুই-তুকারি শুরু করে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। এক পর্যায় বলেন-‘তোর নাম মামলায় ঢুকিয়ে দেব। তুই গাড়ি ডাকাতি করিস।’ এরপর রবিউল দিহানের পরিচয় দিয়ে ওসিকে ফোন ধরিয়ে দেন। ওসি দিহানের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার পর কনস্টেবল সাইফুলকে ডেকে বলেন, ‘ওকে হাজতখানায় আটকে রাখো।’ মুঠোফোন রেখে রবিউলকে থানার একটি কক্ষে তাকে আটকে রাখা হয়। ইফতারের পর পরিবারের সাথে যোগাযোগ করার জন্য রবিউলকে ফোন দেওয়া হয়। খবর পেয়ে রবিউলের বড় ভাই ঘরে থাকা ধনিয়া বিক্রির টাকা ও প্রতিবেশিদের কাছ থেকে ধার-দেনা করে ৫০ হাজার টাকা যোগাড় করে দিহানের মাধ্যমে ওসিকে দেন। নানা নাটকীয়তার পর রাত সাড়ে ৭টার দিকে রবিউলকে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু সে কোন রাজনীতির সাথে জড়িত না।
৯ বছর আগে আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কৃত ব্যক্তিকেও আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সাথে মামলায় আসামি করার অভিযোগ উঠেছে। শাহজালাল নামে ওই ভুক্তভোগী পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) কমপ্লেইন সেলে লিখিত অভিযোগ করেছেন। অভিযোগে জানা গেছে, ২০১৬ সালে ইউপি নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের বিপক্ষে কাজ করার অভিযোগে তাকে মাহমুদপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে বহিস্কার করা হয়। এরপর থেকে আওয়ামী লীগের সাথে তার কোন সম্পৃক্ততা নেই। কিন্তু এসআই হারুন অর রশিদের নেতৃত্বে পুলিশ তার বাড়ি ও এলাকায় গিয়ে একাধিকবার মহড়া দেয়। তাকে বাড়ি না পেয়ে তার পরিবারের লোকজন ও স্থানীয় এক আ.লীগ নেতার কাছে বলে যান, ‘কিছু টাকা নিয়ে ওসি স্যারের সাথে থানায় গিয়ে যেন দেখা করে আসে।’ শাহজালাল নিজেকে নির্দোষ প্রমাণে আত্মবিশ^াসী হওয়ায় ওসির সাথে যোগাযোগ করেননি। ওসি-এসআই ক্ষিপ্ত হয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি সন্ত্রাসবিরোধী আইনে কাশিয়ানী থানায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের শতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে করা মামলায় শাহজালালকে আসামি করা হয়েছে। ভুক্তভোগী শাহজালাল বলেন, ‘আমি কোনো দলের সাথে জড়িত না। নিরপরাধ হয়েও মিথ্যা মামলার আসামি হয়েছি। এবার বাড়িতে ঈদ করতে পারিনি। পালিয়ে বেড়াচ্ছি। এসআই হারুন অর রশিদ টাকা না পেয়ে আমাকে রাজনৈতিক মামলায় আসামি করেছে। অথচ এসআই হারুন অর রশিদ কুমারিয়া বাজারে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে বসে আড্ডা দেয় এবং চা খান।’ এমনই এক ভুক্তভোগী একই গ্রামের জসিম উদ্দিন শিপলু। তিনিও কোন রাজনীতির সাথে জড়িত না থাকলেও, তাকেও একই মামলায় আসামি করা হয়েছে।
এ বিষয় মামলার বাদী এসআই মাহবুবুল আলমের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমি আসামি কাউকে চিনি না। ওই এলাকার চৌকিদাররা যেসব নাম দিয়েছেন, তাদেরকে আসামি করা হয়েছে।’ এদিকে, গত দেড় মাসে মাত্র একজন এজাহারভূক্ত ও ৯ জন অজ্ঞাতনামা আসামিকে গ্রেফতার করেছে। নিরপরাধ মানুষকে অজ্ঞাত আসামি হিসেবে ধরে হয়রানির অভিযোগ ভূক্তভোগীদের।
টাকা হলেও ওসি শফিউদ্দিন সবই পারেন। ওসিকে টাকা দিলেই নিরীহ-নিরপরাধ মানুষকেও রাজনৈতিক মামলার ‘অজ্ঞাত আসামি’ করে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেন। গত ২২ মার্চ উপজেলার চরচাপ্তা গ্রামের কৃষক আনোয়ার হোসেন ডেলিমকে রাত সাড়ে ৮টার দিকে নিজ বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যান এসআই হারুন অর রশীদ। ডেলিমের স্ত্রী রোকসানা বেগমের অভিযোগ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে ঘোনাপাড়া গ্রামের হাসিব নামে এক যুবকের সাথে তার স্বামীর বিরোধ চলছিল। ওই যুবক ওসিকে টাকা দিয়ে তার স্বামীকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়েছে। তার স্বামী কোন রাজনীতির সাথে জড়িত না।
আরজু রহমান নামে এক ভুক্তভোগী নারী জানান, জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে তার সৎ মা আদালতে একটি চুরির মামলা দায়ের করেন। বিষয়টি তদন্ত করে ওসিকে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন আদালত। ওসি শফিউদ্দিন উভয়পক্ষকে থানায় ডেকে সমঝোতা করে দেন। পরবর্তীতে প্রতিপক্ষের নিকট থেকে আর্থিক সুবিধা পেয়ে গোপনে আদালতে মিথ্যা প্রতিবেদন পাঠিয়ে দেন। ঘটনার দিন মামলার তিন নম্বর আসামি ঢাকায় চাকরিরত থাকলেও প্রতিবেদনে তাকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত দেখিয়েছেন।
উপজেলার সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কাশিয়ানী থানায় টাকা ছাড়া কোনো কিছুই হয় না। এছাড়া কাউকে আটকের পর তার আত্মীয়-স্বজনরা কারণ জানতে থানায় গেলে ওসি খুব উত্তেজিত হয়ে যান। আসামির স্বজনদের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করেন এবং অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন।
এদিকে, ওসি শফিউদ্দিন কাশিয়ানী থানায় যোগদানের পর থেকে উপজেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি। বেড়ে গেছে, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, লুটপাট, ভূমিদখল ও হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ড। ওসির এসব কর্মকান্ডে অন্তবর্তীকালীন সরকার ও মাঠে থাকা রাজনৈতিক দলের প্রতি সাধারণ মানুষের বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে।
কাশিয়ানী থানার ওসি মো. শফিউদ্দিন খানের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি এসব অভিযোগের বিষয় অস্বীকার করেন।