,

আজও কাঁদছে সেই ‘রেণুর পরিবার’

জেলা প্রতিনিধি, লক্ষ্মীপুর: ২০১৯ সালে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের তাসলিমা আক্তার রেণুকে, যা ছিল দেশের ইতিহাসে নির্মম, ভয়াবহ ও আলোচিত ঘটনা।

একই সময়ে সারা দেশে ২১টি গণপিটুনির ঘটনায় নিহত হয়েছিল আরও ৫ ব্যক্তি।  পদ্মা সেতুতে শিশুর মাথা লাগবে এমন গুজবে ছেলে ধরা সন্দেহে তাদেরকে হত্যা করা হয়।

নিহত রেণুর পৈতৃক বাড়ি রায়পুর উপজেলার সোনাপুর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডে হলেও ছোটবেলা থেকেই ঢাকায় বসবাস করতেন তারা। তবে তাকে কবর দেওয়া হয় গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে। ৫ বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট আদরের কথা ভেবে আজও স্বজনদের জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে দুচোখ ভাসাচ্ছেন তার বৃদ্ধ মা।

জানা যায়, ২০১৯ সালের ২০ জুলাই সকালে উত্তর-পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাসলিমা আক্তার রেণু তার চার বছরের মেয়েকে ভর্তি করানোর বিষয়ে খোঁজ নিতে যান। কিন্তু সেখানে উপস্থিত কয়েকজন নারী তাকে ছেলেধরা সন্দেহ করে এই গুজব বাইরে ছড়িয়ে দেন। এ খবরে আশপাশ থেকে মুহূর্তেই বিভিন্ন বয়সি কয়েকশ নারী-পুরুষ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়ে। তাদের রোষানল থেকে রক্ষা করতে তাসলিমাকে দোতলায় প্রধান শিক্ষকের কক্ষে নিয়ে রাখা হলেও অতিউৎসাহী হয়ে কিছু কিছু উচ্ছৃঙ্খল মানুষ সেখানকার কলাপসিবল গেট ভেঙে দোতলায় প্রধান শিক্ষকের কক্ষ থেকে তাসলিমাকে টেনেহিঁচড়ে নিচে নামিয়ে এনে এলোপাতাড়ি লাথি, কিলঘুষিসহ লাঠি দিয়ে পেটায়। অবশেষে আধাঘণ্টা পর্যন্ত অমানবিক নির্যাতনের স্বীকার হয়ে তাসলিমা আক্তার রেণু ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে।

সেই অনাকাঙ্ক্ষিত হত্যার ঘটনায় নিহতের ভাগ্নে সৈয়দ নাসির উদ্দিন টিটু ৪০০-৫০০ জনকে আসামি করে মামলা করেছিলেন। ২০১৯ সালের নভেম্বরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) সেই হত্যার তদন্তভার পায় এবং রেণু হত্যার ভিডিও ফুটেজ ও স্থির ছবি যাচাই করে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ মিলিয়ে ৫০ জন জড়িত থাকার বিষয় নিশ্চিত করেন। কিন্তু পরবর্তী সময় পুনরায় পর্যবেক্ষণ শেষে ওই ঘটনায় ১৯ জনকে চূড়ান্ত শনাক্ত করা হয়েছিল। যার মধ্যে ১৪ জন হয়েছিল গ্রেফতার। একজন ছিল পলাতক, বাকি চারজনের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা না পাওয়ায় আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র দিতে পারেনি মামলার তৎকালীন তদন্তকারী কর্মকর্তা (ডিবি) পরিদর্শক আবদুল হক।

ঘটনার তিন বছর আগে স্বামী তসলিম হোসেনের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ডিভোর্স হয়ে যায় তাদের। এর পর ছেলে মাহির থাকত বাবার কাছে ও চার বছর বয়সি মেয়ে তুবা থাকত তার মায়ের সঙ্গে।

মায়ের মৃত্যুর পর থেকেই তুবা তার মায়ের বড় বোনের সঙ্গে থাকে এবং তাকেই মা বলে ডাকে। মাহিরকে হোস্টেলে রেখেই চালানো হচ্ছে পড়াশোনা।

নিহত তাসলিমা আক্তার রেণু ইডেন কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করেছিলেন। বিয়ের পর তিনি ব্র্যাক ও আড়ংয়ে চাকরি করতেন। ছেলে মাহির বয়স যখন দেড় বছর, তখন তিনি চাকরি ছেড়ে দেন।

মামলার বাদী, নিহত তাসলিমা আক্তার রেণুর ভাগ্নে (বোনের ছেলে) সৈয়দ নাসির উদ্দিন টিটু সাংবাদিকদের বলেন, ‘কিছু দিন পরেই পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধন হবে। আমরা গর্বিত বহির্বিশ্বের নিকট ঋণ না নিয়ে নিজেদের অর্থায়নে আজ আমাদের বহুল কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণ হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে-আমার খালামনির (নিহত রেণু) হত্যাকাণ্ডের বিচার আজও সম্পন্ন হলো না। আমার খালামনি হত্যাকাণ্ডের বিচার হলে আমরা (রেণুর দুই বাচ্চাসহ) পুরো পরিবার পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধন সেলিব্রেট করতে পারতাম। কারণ গুজব আমার খালার প্রাণ কেড়ে নিলেও ষড়যন্ত্রকারীরা পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ থামাতে পারেনি। আমি এবং আমাদের পরিবার প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নিকট বিনীত অনুরোধ জানিয়ে আমার খালামনি (রেণু) হত্যার আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তিসহ দ্রুতবিচার চাই।’

বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. জাহিদুল ইসলাম জানান, এ মামলায় ১৩ জন প্রাপ্তবয়স্ক ও দুজন অপ্রাপ্ত বয়স্ক। শিশু দুজনের বিচার শিশু বিচার ট্রাইব্যুনালে চলছে। আমরা সরকার পক্ষের আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শক্রমে যত দ্রুত সম্ভব এ মামলার বিচারকার্য সম্পন্ন করব।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট আফরোজা ফারহানা আহমেদ জানান, সরকার খুবই আন্তরিক এ মামলার অগ্রগতির ব্যাপারে। করোনা মহামারিসহ বিভিন্ন জটের কারণে সময় লাগছে। চলতি বছরের ১৬ মে বাদীর সাক্ষী এবং জবানবন্দি গৃহীত হয়েছে। আগামী ২৬ জুন পরবর্তী সাক্ষীর দিন ধার্য আছে। আমরা চেষ্টা করব মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করার জন্য।

এই বিভাগের আরও খবর