,

অনুমোদন নেই ৮ হাজার ইটভাটার

নিজস্ব প্রতিবেদক: ঢাকার আশপাশে শত শত অবৈধ ইটভাটা গড়ে উঠেছে। এতে রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। বসবাস অযোগ্য হয়ে উঠেছে ঢাকার উপকণ্ঠ এবং সেই সঙ্গে রাজধানী ঢাকাও। শহর এলাকায় বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ হচ্ছে ইটভাটা এবং যানবাহনের ধোঁয়া। বায়ু দূষণকারী নগরীগুলোর মধ্যে ঢাকা অন্যতম।

দেশে ইট পোড়ানো মৌসুম চলছে। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, লোকালয় ও বনাঞ্চলের আশপাশে, পাহাড়ের পাদদেশে এবং দুই বা তিন ফসলি কৃষি জমিতে ইটভাটা পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়াও অনেক ইটভাটায় সরকার নির্ধারিত উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে না। ফলে পরিবেশগত বিপর্যয়সহ জীববৈচিত্র্য ও জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে বায়ুদূষণের জন্য প্রধানত দায়ী প্রচলিত ইটভাটা। দেশের প্রায় ৮ হাজার ইটভাটা রয়েছে, যার বেশির ভাগেরই অনুমোদন নেই কিংবা পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। এসব ইটভাটায় ইট তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে ফসলি জমির উর্বর ও সারযুক্ত উপরিভাগের মাটি। এতে জমির উর্বরতা শক্তি ও ফসল উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ফলে এসব জমি চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। এতে হুমকির মুখে পড়বে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা। যত্রতত্র গড়ে ওঠা এসব অবৈধ ইটভাটার আগ্রাসনে বিনষ্ট হচ্ছে তিন ফসলি জমি। যা কৃষি নির্ভর  জনবহুল দেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। ইটভাটা সৃষ্ট দূষণ এবং কৃষি উর্বর মাটির অবক্ষয় থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে এ সেক্টরে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আনয়ন জরুরি। পরিবেশগত দূষণমাত্রা, অবক্ষয়, শস্যের ফলনহানি এবং সর্বোপরি জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় ইটভাটার দূষণকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে। একই সঙ্গে ইটভাটায় অবাধে পোড়ানো হচ্ছে জ্বালানি কাঠ ও নিম্নমানের কয়লা। এতে উজাড় হচ্ছে বন এবং দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ইটভাটা সৃষ্ট দূষণে গর্ভবতী মা, বয়স্ক ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কালে ধেয়ার কারণে মানুষের ফুসফুসের সমস্যা, শ্বাসকষ্ট ও ঠাণ্ডাজনিত নানা এগও বাড়ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে বছরে ৩৭ হাজার মানুষ মারা যায়, যাদের বয়সের গড় মাত্র ৩৮ বছর। সংস্থাটির ২০১৮ সালের এক গবেষণায় ঢাকাকে বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ দূষিত শহর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শুধু ঢাকা নয়, বাংলাদেশের সব বড় শহরের দূষণচিত্র প্রায় একই রকম। গ্রামাঞ্চলের অবস্থাও ভালো নেই।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর বিভিন্ন সময় বেশ কিছু অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল। ইট পোড়ানোর কাজে ব্যবহৃত বৈধভাবে আমদানিকৃত কয়লা অত্যন্ত নিম্নমানের ও উচ্চ সালফার যুক্ত। এই সালফার মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। ইট পোড়াতে নিম্নমানের কয়লা ব্যবহার করায় সৃষ্টি হচ্ছে মারাত্মক বায়ুদূষণ। অভিযোগ রয়েছে, ভাটা মালিকরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ‘ম্যানেজ’ করেই এসব ইটভাটা চালিয়ে আসছেন।

সম্প্রতি বেসরকারি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর গবেষণায় জানা গেছে, বায়ুদূষণে প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে আবহাওয়াজনিত ও ভৌগোলিক কারণ। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, মানবসৃষ্টি কারণগুলোর মধ্যে নগর-পরিকল্পনার ঘাটতি, আইনের দুর্বলতা, আইন প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা অন্যতম কারণ। ক্যাপস এক গবেষণার ভিত্তিতে বলছে, অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজ থেকে সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ হয়, যা মোট দূষণের ৩০ শতাংশ। এছাড়া ইটভাটা ও শিল্পকারখানায় ২৯ শতাংশ, যানবাহনের কালো ধোঁয়া ১৫ শতাংশ, আন্তর্দেশীয় বায়ুদূষণের ১০ শতাংশ, গৃহস্থালি ও রান্নার চুলা থেকে নির্গত দূষণ ৯ শতাংশ, বর্জ্য পোড়ানো থেকে ৭ শতাংশ বায়ুদূষণ হয়। প্রতিষ্ঠানটির গবেষণায় দেখা গেছে, গত ছয় বছরে ঢাকার মানুষ মাত্র ৩৮ দিন ভালো বায়ু গ্রহণ করতে পেরেছে। যা গত ছয় বছরের মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ সময়। ক্যাপস-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এই পাঁচ বছরের থেকেও ২০২১ সালে গড় বায়ুদূষণের পরিমাণ বেড়েছে ৭ শতাংশ। চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সূচক ২১৯.৫৯ এসে দাঁড়ায়, যা খুবই অস্বাস্থ্যকর।

পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান বলেন, দেশে গাছ লাগনো আজ একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আমরা তার কাঙ্ক্ষিত সুফল পাচ্ছি না। এজন্য পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, বন অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, মেজিস্ট্রেসী এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। ইটভাটা আইন বাস্তবায়নে ভাটার মালিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর