জেলা প্রতিনিধি, গোপালগঞ্জ: প্রতি বছর কৃষি খাতে নানা ভর্তুকি, প্রণোদনা, বরাদ্দ ও প্রকল্পে খরচ করা হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। তবে সে টাকার সুফল পাচ্ছেন না প্রান্তিক কৃষকরা। তদারকি ও জবাবদিহিতা না থাকায় প্রকৃত কৃষকরা সরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অগ্রাধিকার পাচ্ছেন কৃষি কর্মকর্তাদের পছন্দের লোক, রাজনৈতিক নেতা, অকৃষক, স্বচ্ছল ও বিত্তশালী কিংবা বড় উদ্যোক্তা। কোন কৃষকই জানেন না; তার নামে কি পরিমাণ বীজ, সার, কীটনাশক ও অর্থ বরাদ্দ হয়েছে। ফলে কৃষি উপকরণ ও প্রণোদনার টাকা যথাযথ বন্টন না করে নয়ছয় করছেন কৃষি কর্মকর্তারা। দরিদ্র কৃষকের সরকারি সহায়তা লুটে পকেট ভারি করছে সংশ্লিষ্ট কৃষি কর্মকর্তারা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, খাদ্য নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ফসলের উন্নত জাত এবং প্রযুক্তি স¤প্রসারণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ১৩টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে- গোপালগঞ্জ-খুলনা-বাগেরহাট-সাতক্ষীরা-ও পিরোজপুর কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প, আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে উন্নতমানের ডাল, তেল ও মসলা বীজ উৎপাদন সংরক্ষণ ও বিতরণ প্রকল্প, চাষী পর্যায়ে উন্নতমানের ডাল, তেল ও মসলা বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ, ও বিতরণ প্রকল্প, ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ, গবেষণা সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ প্রকল্প, রাজস্ব প্রকল্প, এনএটিপি-২ প্রকল্প, পারিবারিক পুষ্টিবাগান স্থাপন প্রকল্প, তৈল জাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প, পরিবেশ বান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রকল্প, বাংলাদেশে শাক-সবজি, ফল ও পান ফসলের পোকা-মাকড় ও রোগবালাই ব্যবস্থাপনায় জৈব বালাইনাশক ভিত্তিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প, সৌরশক্তি ও পানি সাশ্রয়ী আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পাইলট প্রকল্প ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প।
এরমধ্যে রাজস্ব প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪ লাখ ৩৭ হাজার ৪১০ টাকা। এ রাজস্ব প্রকল্পের আওতায় কাশিয়ানীতে ৯০টি সরিষা, ৫০টি বোরো, ৫টি ভুট্টা, ৮টি গম, ৬টি পেঁয়াজ ও একটি চিনা বাদামের প্রদর্শনী রয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী ৩৩ শতক একটি সরিষা প্রদর্শনীতে বীজ দেড় কেজি, ইউরিয়া সার ৩৫ কেজি, ডিএপি ২৫ কেজি, এমওপি ১৫ কেজি, জিপসাম ২০ কেজি, বোরিক এসিড ১.৫ কেজি, দস্তা ১ কেজি, আন্ত:পরিচর্যা ১ হাজার টাকা, রেজিষ্ট্রার-কলম বাবদ ১০০ টাকা, সাইনবোর্ড ৭০০ টাকা, পরিবহন ৪৩৫ টাকা, আনুসাঙ্গিক ব্যয় ৩০০ টাকা, কৃষক ব্রিফিং ভাতা ৫০০ টাকাসহ মোট ৬১৮৩ টাকা বরাদ্দ থাকলেও কৃষক পাচ্ছেন ১ থেকে ২ কেজি বীজ, চার প্রকার মিলে ৪০ থেকে ৫০ কেজি সার। সর্বসাকুল্যে যার মূল্য ১ হাজার থেকে ১২ শ’ টাকা।
দক্ষিণ ফুকরা গ্রামের কৃষক হারুন মোল্যা জানান, তিনি সরিষা প্রদর্শনীর জন্য সরিষা বীজ ২ কেজি, ইউরিয়া সার ২০ কেজি, ডিএপি ১৫ কেজি, পটাশ ১৫ কেজি জিপসাম ১৫ কেজি পেয়েছেন। নগদ কোন টাকা পাননি। এমনকি কৃষি অফিস থেকে বীজ আনার সময় তার কোন স্বাক্ষর লাগেনি। জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে নিয়ে এসেছেন।
একই প্রকল্পের চিনা বাদাম প্রদর্শনীতে বীজ ১৪ কেজি, ইউরিয়া সার ৫ কেজি, ডিএপি ২৫ কেজি, এমওপি ১৫ কেজি, জিপসাম ১৫ কেজি, বোরিক এসিড ১.৫ কেজি, দস্তা ৫০০ গ্রাম, আন্ত:পরিচর্যা ১ হাজার টাকা, কৃষক ব্রিফিং বাবদ ৫০০ টাকাসহ অন্যান্য বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু উপজেলার চরভাটপাড়া গ্রামের কৃষক দীলিপ দাসের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে- তিনি বাদাম বীজ ১০ কেজি, ইউরিয়া সার ৮ কেজি, ডিএপি ১৮ কেজি, জিমসাম ১১ কেজি ও পটাশ ১১ কেজি পেয়েছেন। এ বিষয় দায়িত্বে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সঞ্জিবন ঘোষের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, ‘একজন কৃষক কতটকু বীজ-সার পাবেন এ বিষয় আমি কিছু বলতে পারবো না। অফিস নিয়ন্ত্রণ করে, অফিস সব কিছু বলতে পারবে।’
রাজস্ব প্রকল্পের বোরো ধানের প্রদর্শনীতে বীজ ৫ কেজি, ইউরিয়া সার ৩৫ কেজি, ডিএপি ১৬ কেজি, এমওপি ১৬ কেজি, জিপসাম ১০ কেজি, দস্তা সার দেড় কেজি, আন্ত:পরিচর্যা ১ হাজার টাকা, রেজিষ্ট্রার বাবদ ১০০ টাকা, সাইনবোর্ড ৭০০ টাকা, পরিবহন ৪৩৫ টাকা, আনুসাঙ্গিক ব্যয় ৩০০ টাকা, কৃষক ব্রিফিং ভাতা ৫০০ টাকাসহ মোট ৫৩০১ টাকা বরাদ্দ থাকলেও কৃষক পাচ্ছেন বীজ ৫ কেজি, ইউরিয়ার সার ৩৫ কেজি, এমওপি ২৫ কেজি, টিএসটি ১৫ কেজি ও জিপসাম ১৫ কেজি।
এদিকে, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ন্যাশনাল এগ্রিকালচার টেকনোলজী গ্রোগ্রাম ফেজ ২ (এনএটিপি-২) প্রকল্পের আওতায় ১৫টি কমিউনিটি বীজ প্রদর্শনী চলমান রয়েছে। এতে একজন কৃষককে বীজ ১০ কেজি, ইউরিয়া ৫০ কেজি, ডিএপি ৪০ কেজি, ডিএপি ৩০ কেজি, জিপসাম ২০ কেজি, দস্তা সার ১ কেজি, বোরন ১ কেজি, বীজ শোধক ১ প্যাকেট, বালাইনাশক ১টি, ড্রাম ২টি ও সাইনবোর্ড ১টি দেওয়ার কথা। কিন্তু বীজ ১০ কেজি, ইউরিয়া সার ১৬ কেজি, ডিএপি ৩৩ কেজি, এমওপি ৩৩ কেজি, দস্তা ১ কেজি, বোরন ১ কেজি, সাইন বোর্ড ১টি দেওয়া হয়েছে।
অপরদিকে, ২০২১-২২ অর্থ বছরে কন্দাল ফসল উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় মিষ্টি আলু, গোল আলু, লতি কচু, পানি কচু, মুখী কচু, ওল কচু ও গাছ আলুর প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করা হয়। এসব প্রদর্শনীতে বীজ-সার, প্রণোদনা, পরিচর্যা, প্রশিক্ষণ ও মাঠ দিবসের জন্য ১৪৮০০ থেকে ২৭০০০ টাকা পর্যন্ত বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু নামেমাত্র সার-বীজ, ৫০০শ টাকা প্রশিক্ষণ ভাতা ও ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বরাদ্দের অধিকাংশ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন কর্মকর্তারা। কোন কৃষকই জানেন না, এসব প্রদর্শনীতে কত টাকা সরকারি বরাদ্দ রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার ব্যাসপুর গ্রামের ইউপি সদস্য বরকত শেখ তার নিজের নামে একটি, স্ত্রী ইয়াসমিন বেগমের নামে একটি, ভাই শফিকুল ইসলামের নামে একটি (ঢাকা চাকরিরত) ও একই গ্রামের জাকির হোসেনের নামের মোট চারটি প্রদর্শনী একা বাস্তবায়ন করেছেন ওই ইউপি সদস্য। যা সম্পর্ণ বেআইনী। একই গ্রামের ঝিলু সরদার অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি গত বছর গাছ আলুর একটি প্রদর্শনী পেয়েছিলাম। ৩০ কেজি আলু ও সাথে ৩২ কেজি ৪ প্রকার সার, ৪০ কেজি গোবর সার পেয়েছিলাম। প্রশিক্ষণ ও নগদ কোন টাকা পাননি।’
এছাড়াও ২০২২-২৩ অর্থ বছরে কৃষি প্রণোদনায় কর্মসূচীর আওতায় গম, ভূট্টা, সরিষা, সূর্যমুখী, চিনাবাদাম পেঁয়াজ মুগ মসুর ও খেসারী ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২ হাজার ২৭০ জন ক্ষদ্র ও প্রান্তিক কৃষককে বিনামূল্যে সার ও বীজ দেওয়া হচ্ছে। এসব তালিকায় ইউনিয়ন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের পছন্দের লোক, রাজনৈতিক নেতা, অকৃষক, স্বচ্ছল ও বিত্তশালী ব্যক্তিদের নাম রয়েছে। অনেকে সরকার নির্ধারিত বীজ-সার পাননি বলেও অভিযোগ রয়েছে। একইভাবে প্রতিটি প্রকল্পের বরাদ্দকৃত টাকা কৃষকের অজানার সুযোগে নামে মাত্র খরচ করে কাগজে-কলমে প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখিয়ে আত্মসাৎ করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ফলে সরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দরিদ্র কৃষকরা। চড়াদামে বীজ-সার কিনে ঋণগ্রস্থ হচ্ছেন অনেকে।
অপরদিকে, সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের আওতায় সরকারি ভর্তুকি মূল্যে সরবরাহ করা সিডার (পাওয়ার টিলার) নিয়েও রয়েছে নানা অনিয়মের অভিযোগ। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার যোগসাজসে নিবন্ধিত ওয়ার্কশপ মালিকরা যন্ত্রের দাম নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি নিচ্ছেন। দুই কোম্পানীর যন্ত্রাংশ মিলিয়ে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে ডিলারদের বিরুদ্ধে। সরকারি সহায়তা বঞ্চিতের ভয়ে মুখ খোলেন না উপকারভোগী দরিদ্র কৃষকরা। এ নিয়ে গত ৯ নভেম্বর চিটাগং বিল্ডার্স ও এসিআই কোম্পানীর দুই ডিলারের মধ্যে হাতাহাতিরও ঘটনা ঘটে। পরে ইউএনও তার কার্যালয়ে দু’জনকে ডেকে নিয়ে বিষয়টি সমঝোতা করে দেন। তবে অনিয়মের বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়।
উপজেলার পারুলিয়া গ্রামের রবিউল মোল্যা জানান, গত ৯ নভেম্বর ২ লাখ টাকার সিডার (পাওয়ার টিলার) ৫০ শতাংশ ভর্তুকি মূল্যে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা ভর্তুতি দিয়ে তিনি নিয়েছেন। জোনাশুর গ্রামের মো. মোরাদ কাজী অভিযোগ করে বলেন, সিডার মেশিনে আমার কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকা বেশি নিয়েছেন ডিলাররা। বিষয়টি কৃষি অফিসের মাজহারুলকে জানালেও তিনি ডিলারদের কথামতো টাকা দিতে বলেন। তবে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কাছে দাম জানতে চাইলে তিনি এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তবে এ বিষয় অন্য কোম্পানীর সাথে কথা বলতে বলেন।
এ বিষয়ে এসিআই কোম্পানীর ডিলার মেসার্স মারুফ মেশিনারীজের স্বত্ত¡াধিকারী মারুফ হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে রাজি হননি।
কাশিয়ানী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ সন্জয় কুমার কুন্ড এসব প্রকল্পের অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি প্রকল্প সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে, তবে মাঠ পর্যায়ের কোন কর্মকর্তা বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’