,

সুন্দরবনে চোরা হরিণ শিকারীরা বেপরোয়া, রেডএলার্ট জারি

শেখ সাইফুল ইসলাম কবির: বিশ্ব ঐতিহ্য একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন ফরেস্ট সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল হরিণ ও সুন্দরী বৃক্ষ। আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারিতে সম্প্রতি সুন্দরবনের বাঘ ও হরিণের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। হ্রাসও পেয়েছিল সুন্দরী গাছ পাচার। কিন্তু চলমান করোনাভাইরাসের প্রার্দুভাবে নদ-নদী ও রাস্তাঘাট অনেকটা ফাঁকা থাকার সুযোগ কাজে লাগিয়ে অসাধু ও চোরা শিকারিরা সুন্দরবনে মেতে উঠেছে হরিণ শিকার এবং গাছ পাচারে।

শুধু বন্যপ্রাণীই নয়, বনের সুন্দরি, পশুর গাছ নিধনসহ বিষ দিয়ে মাছ শিকারের মহোৎসব চলছে বনের ভেতরের নদী-খালে। সংঘবদ্ধ বৃক্ষচোর, বিষ প্রয়োগকারী দুর্বৃত্ত ও চোরা শিকারিদের তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সুন্দরবনে রেড এলার্ট জারি করে টহল জোরদার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ।সাম্প্রতিক সময়ে সুন্দরবনে উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে চোরা হরিণ শিকারীদের তৎপরতা। সুন্দরবনের বাঘের চামড়া ও হরিনের মাংসসহ চামড়া পাচার এখন নিত্য দিনের ঘটনা হয়ে দাড়িয়েছে। সেই সাথে গত ২ ফেব্রুয়ারী ৪২ কেজি হরিণের মাংসসহ চোরা শিকারী বাবা-ছেলে, ২২ জানুয়ারী শরখোলা উপজেলার রায়েন্দা বাজার বাসস্টান্ড সংলগ্ন এলাকা থেকে ১৯টি হরিণের চামড়াসহ শরণখোলা উপজেলার দুই বাসিন্দা, ১৯ জানুয়ারী সুন্দরবনের পাহারাদার হিসাবে খ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামরাসহ এক জেলে, ৩০ জানুয়ারী ৪৭ কেজি হরিণের মাংস দুই চোরা শিকারী ও ৩১ জানুয়ারী ২২ কেজি মাংসসহ এক চোরা শিকারী পাচারকারী গ্রেফতারের ঘটনায় উঠে এসেছে সুন্দরবনের উদ্বেগজনক চিত্র।

২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সুন্দরবনকে দস্যু মুক্ত ঘোষনায় সুন্দরবনে বাঘ ও হরিণ শিকার কমে এসেছে বলে বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন দাবী করলেও গত ছয় মাসে (জুলাই ২০২০ থেকে ফেব্রুয়ারীর ৩ তারিখ পর্যন্ত) বিভিন্ন সময় সুন্দরবন থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে ৩৪  জন চোরা শিকারীকে। এসময় জব্দ করা হয়েছে ১টি বাঘের চামড়া,১৫৩৪ কেজি হরিণের মাংস ও ৪৫হাচোরা শিকারীদেরজীর ফুট হরিণ শিকারের ফাঁদ। জব্দ করা হয়েছে ৯টি নৌকা আর মামলা হয়েছে ১৮টি। এটা শুধু সুন্দরবনে ধরা পরা চোরা শিকারীদের পরিসংখ্যান। এর বাইরে চোরা শিকারিরা কি পরিমাণ হরিণ হত্যা করে মাংস চালান করেছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই কারও কাছে। তবে বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ বলেছে বিভিন্ন সময় পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ থেকে পাশপারমিট নিয়ে ছন্মবেসে থাকা এক শ্রেনীর জেলে ও সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারাই এই বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচারের সাথে জড়িত। তবে শরণখোলা উপজেলার জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় জেলেদের অভিযোগ শুধু জেলে বনজীবী ও স্থানীয় বাসিন্দারা নয় বণ্যপ্রাণী শিকার ও পাচারের সহযোগী হিসাবে বন কর্মকর্তা ও বনরক্ষিরাও জড়িত।

বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন তথ্য সূত্রে জানা যায়, গত ৩০ মার্চ ২০২০ থেকে ফেব্রুয়ারীর ৩ তারিখ ২০২১ পর্যন্ত বনবিভাগ, পুলিশ, র‌্যাব ও কোস্টগার্ডের অভিযানে ২৩৪ কেজি হরিণের মাংস জব্দ করা হয়। এর সাথে দুই হাজার ৫২৫ফুট হরিণ শিকারের ফাঁদ ও ৯টি নৌকা জব্দ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। হরিণ শিকার ও বাঘ ও হরিণের চামড়া পাচারের অপরাধে গ্রেফতার হয় ৩১ চোরা শিকারি। এসব ঘটনায় করা ২৩টি মামলায় আসামি পলাতক রয়েছে ৫৫ জন। বিভিন্ন সময় গ্রেফতার এ জেলে বনজীবী ও চোরা শিকারীদের কাছ থেকে গত ১১ মাসে ২৪টি জীবিত হরিণ, ১০টি হরিণের মাথা, ৩০টি পা জব্দ করা হয়। গত ২০১৯ সালের ২২ মে সর্বশেষ বাঘ জরিপে সুন্দরবনে বর্তমানে বাঘ রয়েছে মাত্র ১১৪ টি। এর মধ্যে ২০০১ সাল থেকে এপর্যন্ত বন বিভাগের হিসেবে ৫৫টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে স্বাভাবিক ভাবে মারা গেছে মাত্র ১৫টি। লোকালয়ে ঢুকে পড়া ১৪টি বাঘকে পিটিয়ে মেরেছে স্থানীয় জনতা, একটি নিহত হয়েছে ২০০৭ সালের সুপার সাইক্লোন সিডরে ও বাকী ২৭টি বাঘ বিভিন্ন সময় হত্যা করেছে চোরা শিকারীরা।

বন বিভাগের তথ্য মতে, জেলে সেজে পূর্ব সুন্দরবন থেকে পাশপারমিট নিয়ে বনে প্রবেশ করে হরিণ হত্যা ও পাচারের অপরাধে বিভিন্ন সময় জেলে ও বনজীবীদের আটক করা হয়েছে। এছাড়া পাশপারমিট বাদেও সুন্দরবনে অবৈধ অনুপ্রবেশ করে হরিণ হত্যা ও পাচারের অপরাধেও আটক হয়েছে অনেকে। এর মধ্যে গত ৪ জুলাই সুন্দরবন সংলগ্ন চিলা বাজারের দক্ষিণ পশুর নদীর তীর একটি জেলে নৌকা থেকে ১৫ কেজি হরিণের মাংস ও নৌকা জব্দ করা হলেও কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। এ ঘটনায় ৩জনকে আসামী করে বন বিভাগ মামলা করলেও সবাই পলাতক রয়েছে। গত ২৬ জুলাই সুন্দরবনের চাড়াখালি খালে দুটি জেলে নৌকাসহ ৩০ কেজি হরিণের মাংস জব্দ করা হলেও কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। এ ঘটনায় ৬জনকে আসামী করে বন বিভাগ মামলা করলেও সবাই পলাতক রয়েছে।

গত ১৫ আগষ্ট সুন্দরবনের কচিখালী অভয়ারণ্য কেন্দ্রের পক্ষিদিয়া চর সংলগ্ন সংরক্ষিত বন থেকে একটি ইঞ্জিন চালিত ট্রলার, ২০০হাত হরিণ শিকারের ফাঁদ ও ২০০ হাত ইলিশ জাল জব্দসহ ৭জন জেলে (বনজীবীকে) আটক করা হয়। এ ঘটনায় বন বিভাগের পক্ষ থেকে একটি মামলা করা হয়। গত ২৫আগষ্ট সুন্দরবনের মরাপশুর খাল থেকে একটি জেলে নৌকা ও ৪২ কেজি হরিণের মাংস জব্দ করা হলেও এ ঘটনাও কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। এ ঘটনায় ৬জনকে আসামী করে বন বিভাগ মামলা কওে এবং ৫জন আসামীর সবাই পলাতক রয়েছে।

গত ২৮ আগষ্ট সুন্দরবনের রায়বাঘিনী খাল সংলগ্ন বনাঞ্চল থেকে হরিণ শিকারের ১৫০ মিটার ফাঁদ, ১টি দা ও ১টি কুড়াল জব্দ করে বন বিভাগ। এ ঘটনায় সুন্দরবনে অবৈধ অনুপ্রবেশের অপরাধে ৩ চোরা শিকারীর নামে মামলা হলেও সবাই পলাতক রয়েছে। গত ৯ সেপ্টেম্বর সুন্দরবন করমজল বণ্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র সংলগ্ন টহল ফাঁড়ির খালের উত্তর পাড় থেকে একটি জেলে নৌকা ও হরিণ শিকারের ৬০ ফুট ফাঁদ জব্দ করে বন বিভাগ। এ ঘটনায় ৪জনকে আসামী করে মামলা করা হলেও সবাই পলাতক রয়েছে। একই দিন সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের পানিরঘাট অফিস সংলগ্ন বনাঞ্চল থেকে হরিণ শিকারের ২০০ মিটার ফাঁদ ও ১টি দা উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায়ও ৩ চোরা শিকারীকে আসামী করে মামলা হলেও সবাই পলাতক রয়েছে।

গত ১১ অক্টোবর সুন্দরবনের পশুর নদী সংলগ্ন খাল থেকে ১টি নৌকা, হরিণ শিকারের ৩০০ হাত ফাঁদ, ২টি খালপাটা জাল, ৫টি ড্রাম, ৩টি দা ও ১টি কুড়ালসহ ৩ জেলেকে আটক করে সুন্দরবন রক্ষায় নিয়োজিত স্মার্ট প্রেট্রোলিং এর সদস্যরা। গত ২০ অক্টোবর সুন্দরবনের জোংড়া টহল ফাঁড়ির সীমানা খাল সংলগ্ন বনাঞ্চল থেকে ১টি জেলে নৌকা থেকে ১ কেজি হরিণের মাংস ১০০ মিটার হরিণ শিকারের ফাঁদ ও ৩টি বৈঠা জব্দ করা হয়। এ ঘটনায় ৪ জেলেকে আসামী করে মামলা করা হলেও সবাই পলাতক রয়েছে। গত ৩০ নভেম্বর সুন্দরবনের কটকা অভয়ারণ্যের জামতলা এলাকা থেকে ১টি হরিণের শিং, ৩৭৫ ফুট হরিণ শিকারের ফাঁদ ও ১টি দা সহ ৫ চোরা শিকারীকে আটক করে বন বিভাগ। এ ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।সুন্দরবনকে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। বাগেরহাট জেলার শরণখোলা রেঞ্জ ও চাঁদপাই রেঞ্জ নিয়ে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ। আর পশ্চিম সুন্দরবন বিভাগে রয়েছে খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জ এলাকা। এর মধ্যে বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগে মাত্র ৩৬ দিনের ব্যবধানে পুলিশ ও বনরক্ষীরা অভিযানে চালিয়ে চোরা শিকারিদের কবল থেকে ২৪টি জীবিত হরিণ, ৭৯ কেজি হরিণের মাংস, নাইলনের দড়ির ছয় হাজার ৬০০ ফুট হরিণ ধরার ফাঁদ জব্দ করেছে। এ সময়ে সাতজন চোরা শিকারিকে আটকসহ তাদের কাজে ব্যবহৃত চারটি ট্রলার ও দুটি নৌকা জব্দ করা হয়েছে।

গত ২১ ডিসেম্বর সুন্দরবনের কুলতলি খাল সংলগ্ন বনাঞ্চল থেকে কেজি ৮০০ গ্রাম হরিণের মাংস, ৫১টি হরিণ শিকারের ফাঁদ ও ১টি দাসহ ১জনকে আটক করা হয়। এ ঘটনায় বন বিভাগের পক্ষ থেকে ৫ চোরা শিকারীকে আসামী করে মামলা হলেও ৪জন পলাতক রয়েছে। এ বছরের ৮ জানুয়ারী সুন্দরবনের সিন্দুরবাড়িয়া খাল থেকে ১টি জেলে নৌকা ও হরিণ শিকারের ৪০০ ফুট ফাঁদ জব্দ করে বন বিভাগ। এ ঘটনায় ৪ জেলেকে আসামী করে মামলা করা হলেও সবাই পলাতক রয়েছে। ১৯ জানুয়ারী সুন্দরবনের পাহারাদার হিসাবে খ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়াসহ র‌্যাব ও বন বিভাগের যৌথ অভিযানে এক জেলে আটক করা হয়। এ ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

২২ জানুয়ারী শরখোলা উপজেলার রায়েন্দা বাজার বাসস্টান্ড সংলগ্ন এলাকা থেকে ১৯টি হরিণের চামড়াসহ শরণখোলা উপজেলার দুই বাসিন্দাকে আটক করে বাগেরহাট ডিবি পুলিশ। এ ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ৩০ জানুয়ারী ৪৭ কেজি হরিণের মাংস ২ চোরা শিকারী আটক করে মোংলা কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের সদস্যরা। এ ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ৩১ জানুয়ারী ২২ কেজি মাংসসহ সুন্দরবন সংলগ্ন শরখোলা উপজেলার এক চোরা শিকারী আটক করে বন বিভাগ। এ ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। আর সর্বশেষ ২ ফেব্রæয়ারী বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার বগুড়া ব্রিজ সংলগ্ন খাল পাড় থেকে ৪২ কেজি হরিণের মাংসসহ চোরা শিকারী বাবা-ছেলেকে আটক করে ডিবি পুলিশ। এ ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শরণখোলা উপজেলার সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার একাধিক জেলে ও বাসিন্দারা  জানান, সুন্দরবনে হরিণ শিকার এখন তো নিত্যদিনের ব্যাপার। জেলে পরিচয়ে সুন্দরবনে পাস পারমিট নিয়ে প্রবেশ করা এক শ্রেনীর চোরা শিকারী সুন্দরবনের হরিণ ও বাঘ হত্যার সাথে জড়িত। এদের সাথে বিভিন্ন সময় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও জেলেরা জড়িত থাকে। ছদ্মবেশে সুন্দরবনে প্রবেশ করা চোরা শিকারীরা সুন্দরবনের সংরক্ষিত এলাকায় অনুপ্রবেশ করে ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে মাংস বিক্রি করে। বনরক্ষীরা যে পরিমাণ হরিণের মাংস উদ্ধার ও শিকারীদের আটক করেছে তার চেয়ে অনেক বেশিই হরিণের মৃত্যু হয়েছে শিকারি চক্রের হাতে। চড়া দামে গোপনে হরিণের মাংস বিক্রি হয়। ১হাজার ৫শ টাকা থেকে শুরু করে দুই হাজার টাকা কেজি পর্যন্ত হরিণের মাংস বিক্রি হয়।

কারা সুন্দরবনের হরিণের মাংসের ক্রেতা এমন প্রশ্নের জবাবে তারা আরও জানান, হরিণের মাংসের ক্রেতার অভাব নেই। হরিণের মাংস এখন হোম ডেলিভারীও করা হয়। সাধারন মানুষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি ও খোদ প্রশাসনের লোকজনও এই মাংসের ক্রেতা। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকা গুলোতে বসবাস করা ধনী পরিবার ও রাজনৈতিক নেতাদের বাড়ীর ফ্রিজে প্রায় সব সময়ই হরিণের মাংস পাওয়া যায়। এছাড়া সুন্দরবন সন্নিহিত জেলা, বাগেরহাট, খুলনা ও পিরোজপুর জেলার চেয়ারম্যান, মেম্বার ও প্রভাবশালী ব্যাক্তিরা চোরা শিকারীদের কাছ থেকে মাংস ক্রয় করে থাকে। অধিক মুনফার আশায় এক শ্রেনীর জেলে ও চোরা শিকারীরা হরিণ শিকার করে তাদের পছন্দের লোকজনদের হোম ডেলিভারি দিয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে কেজি প্রতি টাকার পরিমান একটু বেশি দিতে হয়। এছাড়াও প্রভাবশালী ব্যাক্তি ও নেতারা লোক পাঠিয়ে হরিণের মাংস সংগ্রহ করে। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও সুন্দরবনে ঘুরতে যাওয়া পর্যটকরা গোপনে হরিণের মাংস ক্রয় করে। এক কথায় একটু চেষ্টা করলেই হাত বাড়ালে হরিণের মাংস পাওয়া সহজ বিষয়।

শরণখোলা উপজেলা মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি আবুল হোসেন  বলেন, কিছু অসাধু জেলে বনজীবীদের অপরাধের দায় কিন্তু সকলের উপর দেয়া যাবে না। সুন্দরবন আমাদের মায়ের মত। আমাদের রুজি-রুটি কিন্তু এ বন থেকেই আসে। সুতরাং সকলকে অপরাধি ভাবা যাবে না। তবে সুন্দরবনের জীব-বৈচিত্র রক্ষায় আমাদের সকলের উচিত জেলে ছদ্মবেসে থাকা এসব চোরা শিকারীদের চিহ্নিত করে তাদের আইনের হাতে তুলে দেয়া।

সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) জয়নাল আবেদিন  বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা যে অভিযোগ করেছে তার কোন ভিত্তি নাই। বন বিভাগের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের কোন সত্যতা নেই। মূলত জেলে বনজীবী ও তাদের নেপথ্যে একটি বড় সিন্ডিকেট আছে শরণখোলা রেঞ্জ সংলগ্ন সুন্দরবনের উপকূলীয় এলাকায়। এরাই সুন্দরবনের হরিণ শিকার ও পাচারের সাথে জড়িত। আমাদের কাছ থেকে যারা পাশপারমিট নিয়ে সুন্দরবনে মাছ, কাকড়া ও মধু আহরণ করতে যাওয়া চোরা শিকারীরা জেলে ছদ্মবেসে বনে প্রবেশ করে এ ধরনের কর্মকান্ড করে থাকে। বন বিভাগের বিভিন্ন অভিযানে এরা আটক হওয়ার পর আমরা জানতে পারি এরা জেলে ছদ্মবেশি চোরা শিকারি। শরণখোলা রেঞ্জের জেলেরা দীর্ঘদিন ধরে সুন্দরবন থেকে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। কিছুদিন আগে বাঘের চামড়াসহ আটক হয় গাউস ফকির। সে কিন্তু সুন্দরবন সংলগ্ন শরণখোলা উপজেলা সাইথখালী গ্রামের বাসিন্দা। পাশপারমিট নিয়ে জেলে হিসাবে সে দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে সুন্দরবনে মাছ আহরন করে আসছিল। এদের মত অনেক জেলে আছে যারা হরিণ শিকার ও পাচারের সাথে জড়িত। এছাড়া এদের পিছনের গডফাদার হিসাবে কিন্তু স্থানীয় নেতা ও জনপ্রতিনিধি রয়েছে। হরিণের মাংসের একটা ভাগ কিন্তু এরাও পায়। এছাড়া আরো কিছু ক্রেতা আছে যারা অসাধু এ জেলে বনজীবীদের কাছ থেকে হরিণের মাংস ক্রয় করে থাকে। তারাও কিন্তু অপরাধি, তারা কিন্তু এসকল অপরাধের ইন্ধনদাতা হিসাবে কাজ করছে।

বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন  জানান, বন অধিদপ্তরের নির্দেশে সুন্দরবন জুড়ে রেডএলার্ট কার্যকরে ম্যানগ্রেভ এই বন বিভাগের সকল ষ্টেশন, ক্যা’ম্প ও ফাঁ’ড়িগুলোকে নি’র্দেশনা দেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, সম্প্রতি সুন্দরবনে বাঘ ও হ’রিণসহ বন্যপ্রাণী নিধন এবং পা’চার বে’ড়ে যাও’য়ায় এ রেড এলার্ট জারি করা হয়েছে। দায়িত্ব পালনে কঠোর নিদের্শনা দেয়া হয়েছে বনরক্ষীদের। এছাড়া বনের অভ্য’ন্তরে টহলও জোর’দার করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বনে ছোট ডিঙ্গি নৌকা চলাচলের উপরও সা’ময়িক নিষে’ধাজ্ঞা আ’রোপ করা হয়েছে।  সুন্দরবনে চোরা শিকারীদের তৎপরতা বন্ধে বন বিভাগ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। আমাদের নিয়মিত অভিযানে বিভিন্ন সময় হরিণের মাংসসহ চোরা শিকারীরা ধরা পড়ছে। এছাড়া সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার লোকজন জেলে সেজে পাশপারমিট নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করে এসব অপকর্মের সাথে জড়িত হয়ে পড়ছে, সে কারনে শিকারীদের রুখতে গত ২৩ জানুয়ারী থেকে সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জে সকল প্রকার পাশপারমিট সাময়িক ভাবে বন্ধ করা হয়েছে। এই চোরা শিকারীরা অনেক শক্তিশালী। এদের বড় নেটওয়ার্ক রয়েছে। এদের ধরতে সুন্দরবন সংলগ্ন লোকজন খুব একটা সহযোগীতা করে না। এদের বিরুদ্ধে মানুষ স্বাক্ষী দিতেও ভয় পায়। যেহেতু স্বাক্ষী পাওয়া যায় না, স্বাক্ষী র্দূবল থাকে। এর ফলে এই চোরা শিকারীরা সেই সুযোগটা নেয়। তারা আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এসে বারবার এই ধরনের অপরাধ করার সাহস করে। এদের যদি কঠিন শাস্তির মুখোমুখি করা যেত তাহলে সুন্দরবনে শিকারীদের তৎপরতা রোধ করা আরও সহজ হত।

তিনি আরও বলেন, আমরা ইতিমধ্যেই সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকা গুলোতে থাকা শিকারীদের একটি তালিকা তৈরী করেছি। তালিকায় থাকা ব্যাক্তিদের নজরদারীর মধ্যে রাখা হয়েছে। এছাড়াও বর্তমানে সার্বক্ষনিক সুন্দরবন পাহারায় আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর স্মার্ট পেট্রোলিং আরও বাড়ানো হয়েছে। সুন্দরবন রক্ষায় বন বিভাগ তৎপর রয়েছেন বলে জানান তিনি।

বাগেরহাট পুলিশ সুপার পংঙ্কজ চন্দ্র রায় বলেন, শরণখোলা কেন্দ্রিক একটি বণ্যপ্রানী পাচার চক্র আছে। যারাই মূলত এ হরিণের মাংস, চামড়া ও বাঘের চামড়াসহ বন্যপ্রানীর বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পাচারের সাথে জড়িত। এদের গডফাদারসহ এসব চোরা শিকারীদের ধরতে বাগেরহাট জেলা পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ তৎপর রয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর