,

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জিম্মি শিক্ষার্থী-অভিভাবক

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর বিভিন্ন নামকরা স্কুল ও কলেজ যেন এক ধরনের নির্যাতন সেলে পরিণত হয়েছে। শাসনের নামে শিক্ষার্থীরা শারীরিক-মানসিক নির্যাতন এবং অভিভাবকরা নানাভাবে হয়রানি ও অপমানের শিকার হচ্ছেন।

গত দু’দিন রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলে সরেজমিন ঘুরে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে আলাপে এসব অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের মতে, এসব প্রতিষ্ঠানে দেশের প্রভাশালী ব্যক্তির সন্তানের সংখ্যাই বেশি।

পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা কমিটির অধিকাংশই সদস্য এ শ্রেণীর প্রতিনিধি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের (প্রভাবশালী) স্ত্রী-সন্তানেরা যোগ দেন শিক্ষক হিসেবে। এ তিন ধরনের ব্যক্তিদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ শিক্ষক।

শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আরও অভিযোগ, শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে অমানুষের মতো আচরণ করেন ওইসব শিক্ষক।

শুধু তাই নয়, কথায় কথায় প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ধরনের ফি বৃদ্ধি, ক্লাসে ঠিকমতো না পড়ানো, কোচিংয়ে বাধ্য করা, ভর্তি ও গাইড বাণিজ্য, প্রতিষ্ঠানে তহবিল তসরুপসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত অসৎ শিক্ষকরা।

এ প্রক্রিয়ায় চিহ্নিত শিক্ষকরা রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। এছাড়া ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করার ঘটনাও ঘটিয়ে থাকেন কোনো কোনো শিক্ষক। এতসব অন্যায় সত্ত্বেও সন্তানের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে অভিভাবকরা মুখ বুঝে সহ্য করেন সব।

অভিভাবকরা জানান, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিযোগ নিষ্পত্তি এবং সুচারুরূপে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ভার থাকে পরিচালনা কমিটির ওপর। কিন্তু সমস্যা সমাধান না করে এক শ্রেণীর সদস্য মদতদাতার ভূমিকায় থাকেন।

দুর্নীতিবাজ শিক্ষকদের সঙ্গে যোগসাজশে তারা লুটপাটে লিপ্ত হন। ফলে বছরের পর বছর সমস্যা জিইয়ে থাকে। এতে প্রায় প্রত্যেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিভাবক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুঞ্জীভূত হচ্ছে ক্ষোভ।

প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে যে কোনো দিন যে কোনো প্রতিষ্ঠানেই ভিকারুননিসার মতো ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অভিভাবকরা।

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো শিক্ষক মানসিক বা শারীরিকভাবে কোনো শিক্ষার্থীকে নির্যাতন করতে পারেন না, এটি অপরাধ।

একজন শিক্ষার্থী কতটা অপমানিত হলে, কতটা কষ্ট পেলে আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নেয় যে ঘটনাগুলো আমরা শুনেছি। এর পেছনের কথাও শুনছি। তিনি বলেন, ঘটনার পেছনে বা ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক, যদি প্রমাণ পাওয়া যায়, জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওই কদর্য দিকের প্রতিফল হচ্ছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের ছাত্রী অরিত্রী অধিকারীর গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা।

এর আগে ২০১২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ওই প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী চৈতী রায় আত্মহত্যা করেন। প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সদস্য অ্যাডভোকেট মো. ইউনুছ আলী আকন্দ বুধবার এ তথ্য তুলে ধরে বলেন, কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে অতীতেও শিক্ষার্থী আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে এ প্রতিষ্ঠানে।

চৈতী নামের ওই মেয়েটি বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে চেয়েছিল। কিন্তু নিয়মের জালে ফেলে প্রথম বছর পড়তে দেয়া হয়নি। মেয়েটি এক বছর নষ্ট করে পুনরায় পরীক্ষা দিলেও তাকে বিজ্ঞানে পড়তে দেয়া হয়নি। পরে মেয়েটি আত্মহত্যা করে।

যদি চৈতীর আত্মহত্যার বিচার হতো, তাহলে অরিত্রী অধিকারীকে মরতে হতো না। এ ব্যাপারে চৈতী রায়ের বাবা রবীন্দ্রনাথ রায় বলেন, আমি চাই স্কুলের স্বেচ্ছাচারিতা আর শিক্ষকের কারণে যাতে আর কোনো বাবাকে সন্তান হারা হতে না হয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব জানান, অরিত্রী অধিকারীর ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে ঢাকার নামি ও বিখ্যাত এবং কয়েকটি সংস্থা পরিচালিত স্কুলগুলোর ভেতরের নানা অন্যায়, অনিয়ম এবং শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের নির্যাতনের নানান দিক উঠে আসছে।

বিভিন্ন সূত্রে আমরা নানান অভিযোগ পাচ্ছি। তিনি জানান, নিউমার্কেট এলাকায় অবস্থিত একটি সংস্থা পরিচালিত স্কুলের ব্যাপারে তারা বেশকিছু অভিযোগ পেয়েছেন।

একাধিক উচ্চপদস্থ সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী জানিয়েছেন, ওই স্কুলে ঘনঘন টিউশনসহ বিভিন্ন ফি ও ভাড়া বাড়ানো হয়। প্রতিষ্ঠানটিতে ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে প্লে শ্রেণীতে টিউশন ফি ছিল ২৬শ’ টাকা। মার্চ মাসে বাড়িয়ে তা ৪ হাজার টাকা করা হয়।

আবার ‘সিকিউরিটি মানি’র নামে সাড়ে ৪ হাজার শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ১০ হাজার করে টাকা নেয়া হয়। নতুন করে ফি বাড়ানোর আবারও পাঁয়তারা চলছে। এভাবে যাতে টাকা না নেয়া হয়, সেজন্য তখন স্বাক্ষর সংগ্রহ শুরু করলে ১৭ অভিভাবককে ডেকে সন্তানের টিসি ধরিয়ে দেয়া হয়।

‘শ’ আদ্যাক্ষরের একজন অভিভাবক বলেন, ওই প্রতিষ্ঠানে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে। হাজারও অভিযোগ থাকলেও কোনো অভিভাবক নামপ্রকাশ করে কোনো তথ্য বা বক্তব্য দেবেন না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থিত একটি স্কুলের বিরুদ্ধেও একই ধরনের অভিযোগ। ওই প্রতিষ্ঠানের এক অভিভাবক বলেন, যেখানে ভিকারুননিসা স্কুলের টিউশন ফি এক হাজার টাকা, সেখানে ওই স্কুলে কেজি শ্রেণীতে ইংলিশ ভার্সনে ৩ হাজার টাকা নেয়া হয়।

প্রতিষ্ঠানে ইংলিশ ভার্সনে শিক্ষকরা ঠিকমতো পড়াতে পারেন না। শিক্ষকদের কাছে কোচিং করতে হয়। কেজি শ্রেণীর পরীক্ষায়ও ফি নেয়া হয় এক হাজার টাকা।

মামুন আহমেদ নামে বকশিবাজার এলাকার একজন অভিভাবক জানান, প্রতিষ্ঠানটি নানান খাতে টাকা নিলেও ছাত্র ও ছাত্রীদের একই বাথরুম-টয়লেটের ব্যবস্থা রেখেছে। যে কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্কুলে অবস্থান করলেও অনেক ছাত্রী বাথরুমে যায় না। এমন পরিস্থিতিতে তিনি নিজের কন্যাকে ওই স্কুল থেকে নিয়ে অগ্রণী স্কুল ও কলেজে ভর্তি করেছেন।

জানা গেছে, এ দুই স্কুলের মতোই রাজধানীর বেশির ভাগ স্কুলেই নানা অনিয়ম-দুর্নীতি এবং শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের নানাভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেপরোয়া দুর্নীতিতে অভিভাবক ও শিক্ষার্থী রীতিমতো জিম্মি হয়ে পড়েছেন।

সন্তানকে মানসিক নির্যাতন করা হয় বলে কোনো অভিভাবক প্রতিবাদের সাহসও করেন না। সন্তানের দিকে তাকিয়ে মুখ বুঝে সব সহ্য করেন তারা।

এসব বিষয় স্বীকার করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জাভেদ আহমেদ বলেন, স্কুলগুলোতে যেসব অপকর্ম ও অন্যায় হচ্ছে তা শুনে চোখের পানি চলে আসে। বেশির ভাগ শিক্ষক বেপরোয়া। নানান কারণে শক্ত ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না।

তবে ভিকারুননিসার ঘটনার পর যেহেতু হাইকোর্ট একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছেন, তাই এখন আমাদের শক্ত হওয়ার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমরা দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নিতে চাই।

বুধবার সরেজমিন পরিদর্শনকালে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা জানান, ছেলেমেয়ে জন্ম দেয়ার পর তাদের মানুষের মতো মানুষ করে তুলতে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় ভর্তি করা হয়।

ভর্তির পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ধার্যকৃত অর্থ জোগান দিতেই ফতুর হওয়ার অবস্থা। তাদের কাছে মাসিক বেতন, পুনঃভর্তি, নতুন ভর্তি, ভর্তি ফরম, কোচিং ফি, প্রগতি বিবরণী, মার্কশিট, ছাড়পত্র, প্রত্যয়ন পত্র, খেলাধুলা, স্কাউট, গার্লস গাইড, দরিদ্র তহবিল, মিলাদ, সাময়িকী, পাঠাগার, সিলেবাস, প্রসপেকটাস, বিজ্ঞানাগার, কম্পিউটার, প্রযুক্তি ফি, স্কুলের নির্ধারিত নোট বই, গাইড বই, খাতা বাবদ, ডায়েরি বাবদ, পরিচয়পত্র বাবদ, পিকনিক, ঈদ পুনর্মিলনীসহ অন্তত অর্ধশত প্রকারের খাতের কথা জানা গেছে।

ভিকারুননিসার ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, তদন্ত করতে গিয়ে তিনি রোমহর্ষক তথ্য পেয়েছেন। শুধু তিনজন ব্যক্তিই দায়ী নন। প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির ব্যাপারেও অভিভাবকদের অনেক আপত্তি।

বিগত ১৯ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানে কোনো স্থায়ী অধ্যক্ষ নিয়োগ করা হয় না। এটা রহস্যজনক ও বড় ধরনের অনিয়ম।

প্রতিষ্ঠানটির দারোয়ান থেকে অধ্যক্ষ পর্যন্ত সবাই নানানভাবে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের নির্যাতন করেন। বেশকিছু অনিয়ম ও অসঙ্গতির তথ্য অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পেয়েছি।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক অধ্যাপক প্রীতিশ সরকার  বলেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা যে কোনো প্রতিষ্ঠানে সুশাসন নিশ্চিতের দায়িত্ব পরিচালনা কমিটির।

কিন্তু প্রায় প্রতিদিনই আমরা রাজধানীসহ বোর্ডের অধীন বিভিন্ন স্কুল সম্পর্কে যেসব অভিযোগ পাই, সেগুলো অনেক ক্ষেত্রেই গুরুতর।

এ ব্যাপারে নানান কারণে ব্যবস্থা নিতে না পারার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, ম্যানেজিং কমিটির কাজ খবরদারি করা নয়। তাদের অন্যতম কাজ সার্বিকভাবে শিক্ষার উন্নয়ন, শিক্ষার্থী-শিক্ষকের গুণগতমান উন্নয়ন, মানবিক মূল্যবোধের উন্নয়নে নজর দেয়া। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেটা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর