,

প্রাচীন নিদর্শন মির্জাপুর শাহী মসজিদ

জেলা প্রতিনিধি, পঞ্চগড়: দেশের অন্যতম ও প্রাচীন নিদর্শন মির্জাপুর শাহী মসজিদ ৷ মুঘল আমলে প্রতিষ্ঠিত পঞ্চগড় জেলার একমাত্র ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন মসজিদ এটি। ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদটি দেশের সর্ব উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা পঞ্চগড়ের পর্যটন শিল্পের একটি অন্যতম উপাদান। মসজিদের অবস্থান দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড় আটোয়ারী উপজেলার মির্জাপুর গ্রামে। মির্জাপুর শাহী মসজিদ এর প্রতিষ্ঠাকাল সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ঐতিহাসিকদের মতে এ মসজিদের বয়স সাড়ে ৩শ বছরেরও বেশি।

অনেকের ধারণা মসজিদটি ষোড়শ শতকের শেষের দিকে নির্মিত। অনেকেই অনুমান করেন এ মসজিদটি ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে (সম্ভাব্য) নির্মিত হয়েছে। কারণ, মির্জাপুর শাহী মসজিদটি ঢাকা হাইকোর্ট প্রাঙ্গনে অবস্থিত মসজিদের সঙ্গে ব্যাপক শৈলীর সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। এ থেকে ধারণা করা হয় ঢাকা হাইকোর্ট প্রাঙ্গনে অবস্থিত মসজিদের সম-সাময়িককালে এই মসজিদের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। তবে মসজিদের দেয়াল থেকে কিছু উদ্ধারকৃত শিলালিপি থেকে অনুমান করা হয় ১৬৫৬ সালের দিকে নির্মাণ করা হয়েছে মসজিদটি। ভারতের সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার শাসনামলে শাহী মসজিদের নির্মাণ কাজ করা হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মির্জাপুর গ্রামের প্রতিষ্ঠাতা মালিক উদ্দিন শাহী মসজিদ নির্মাণের এই মহান কাজটি করলেও দোস্ত মোহাম্মদ নামে এক ব্যক্তি এ মসজিদের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন  বলে ব্যাপক জনশ্রুতি রয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, তিন গম্বুজবিশিষ্ট মির্জাপুর শাহী মসজিদের দৈর্ঘ্য হলো ৪০ ফুট ও প্রস্থ ২৫ ফুট। মসজিদের মধ্যবর্তী দরজার উপরিভাগে নির্মাণ সম্পর্কে পারস্য ভাষায় লিখিত একটি ফলক রয়েছে। সে ফলকের ভাষা ও লিপি থেকে ধারণা পাওয়া যায়, মুঘল সম্রাট শাহ আলমের রাজত্বকালে এই মসজিদের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। এছাড়াও মোগল স্থাপত্য রীতির বৈশিষ্ট্য ভরপুর সুসজ্জিত মির্জাপুর শাহী মসজিদের গম্বুজের শীর্ষবিন্দু ক্রমহ্রাসমান বেল্ট দ্বারা যুক্ত।

মসজিদের দেওয়ালে টেরাকোট ফুল এবং লতা পাতার বিভিন্ন খোদাই করা নকশা আছে, যা সহজেই আকৃষ্ট করে পর্যটকদের। মসজিদের দেয়ালে যে সারি সারি নকশা রয়েছে, সেগুলোর একটির সঙ্গে অন্য আরেকটির মিল পাওয়া যায় না।  এ মসজিদের চার কোণে চারটি মিনার রয়েছে। সামনের দেয়ালের দরজার দুইপাশে গম্বুজের সঙ্গে মিল রেখে দুইটি মিনার দৃশ্যমান। মসজিদের দেয়ালে ব্যবহার করা ইটসমূহ চিক্কন, রক্তবর্ণ ও বিভিন্ন অলংঙ্কৃত এবং দেয়ালের চারপাশ ইসলামি দোরাকাটা ফুল ও লতাপাতার নকশায় পরিপূর্ণ। বিশেষ করে মসজিদের মধ্যবর্তী দরজায় ফারসিলিপি খচিত মুদ্রার কালো ফলক, ফলকের লিপি ও ভাষা থেকে অনুমান করা যায়— এ মসজিদটি মুঘল সম্রাট শাহ আলমের শাসনামলে নির্মিত হয়েছে।

শুধু তাই নয়, মসজিদের তিনটি বড় বড় দরজা রয়েছে। মসজিদের দেয়ালে কারুকার্য ও বিভিন্ন আকৃতির নকশা করা । মসজিদের ভেতরের দেয়ালে খোদাই করা কারুকার্য বিভিন্ন রঙের এবং বিভিন্ন ফুল, লতাপতাসহ কোরআনের সংবলিত ক্যালিওগ্রাফি তুকির ছোঁশায় সজ্জিত করা— যা দর্শনার্থীদের আরও আকৃষ্ট করে।

এছাড়াও ঐতিহ্যবাহী প্রচীন এ মসজিদের সামনে একটি উন্মুক্ত খোলা জায়গা রয়েছে। একপাশে সুসজ্জিত পাকা তোরণসহ মসজিদের উভয় পাশে নকশা ও খাঁজ করা স্তম্ভ রয়েছে। স্তম্ভগুলো মাঝে চ্যাপ্টা গম্বুজ, তোরণকে আরও সুন্দর করে তুলেছে। আর সুসজ্জিত গম্বুজের উপরে মুদ্রার আকৃতি চূড়া রয়েছে। প্রাচীন মসজিদটি বয়স কয়েকশ বছর হলেও কোনো ক্ষতি হয়নি এখনও পর্যন্ত।  ইটের গাথুনি, দেয়াল, প্লাস্টার ও নকশাসহ সব কারুকাজ শক্ত ও মজবুতভাবে দাঁড়িয়ে আছে৷  তবে কয়েক বছর আগে ভূমিকম্পে মসজিদের কিছু অংশ ভেঙে গেলে তার পরে আবার সংস্কার করা হয়।

মসজিদের সামনে রয়েছে একটি পুকুর,পুকুরের সামনে রয়েছে ফুলের বাগান। পুকুর পাড়ে দাড়ালে দর্শনার্থীরা আরও মুগ্ধ হয়ে পড়ে। মসজিদের এক পাশে প্রায় ৫০গছ দূরে রয়েছে ইমামবাড়া বা হোসেনি দালাল। ইটের তৈরি ইমামবাড়াটি ভেতরে গোলাকার এবং একটি কক্ষ রয়েছে ৷ আর এ  ইমামবাড়ার ভেতরের কক্ষে মুসলমানদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা হতো। স্থানীয়রা জানান সেখানে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে ধর্মীয় নেতারা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করতেন। তবে জরাজীর্ণ ও অসংরক্ষিত হিসেবে ইমামবাড়াটি পড়ে রয়েছে।

অনেকদিন আগে প্রবল এক ভূমিকম্পে মসজিদটির বেশ কিছু অংশ ভেঙে যায়। তখন মির্জাপুর গ্রামের বাসিন্দা মালিক উদ্দিন মসজিদের পুনঃসংস্কারের জন্য সূদূর ইরান থেকে কারিগর নিয়ে আসেন তখন সেই কারিগর শাহী মসজিদ সংস্কার করেন। এরপর থেকে আর কোনো প্রকার সংস্কারের কাজ হয়নি । তবে মসজিদটি দেখতে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ সমাগম ঘটে সারা বছরই। মসজিদের সংস্কারের পাশাপাশি ইমামবাড়াটি যদি পরিষ্কার করে সংরক্ষণ করার দাবী স্থানীয়দের।

শাহী মসজিদের নকশা খচিত কারুকাজ দেখার জন্য দেশি-বিদেশি পর্যটক, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ ভিড় করে প্রতিদিনই। অনেকেই আবার স্মৃতি ধরে রাখতে নামাজ আদায় করেন। প্রথম বারের মতো অনেকই এই মসজিদে দেখার ফলে উল্লাসিত বলে জানান তারা।

আটোয়ারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু তাহের মো. শামসুজ্জামান  জানান, আটোয়ারী মির্জাপুর শাহী মসজিদ এটি একটি প্রাচীন নিদর্শন। পঞ্চগড় জেলার যেসব  দর্শনীয় স্থান রয়েছে তার মধ্যে এটি অন্যতম। মসজিদের নিরাপত্তা ও পবিত্রতা রক্ষায় উপজেলা প্রশাসন সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে। বাইরে থেকে মানুষ এসে যেন মসজিদের কারুকাজ উপভোগ করতে পারে সেক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তা বিষয়টি বেশী গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এছাড়া মসজিদের পাশে যে ইমামবাড়াটি রয়েছে সেটা জরাজীর্ণ হওয়ায় সেটিও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংস্কাররে উদ্যােগ গ্রহন করা হয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ইতিমধ্যে চিঠিও প্রেরন করা হয়েছে সংস্থারের জন্য ।

এই বিভাগের আরও খবর