,

প্রতারক লিটনের মদদদাতা কারা, খতিয়ে দেখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

নিজস্ব প্রতিবেদক: চাঁদাবাজি, প্রতারণা, সাইবার অপরাধসহ এক ডজনের মতো মামলার আসামি ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার সিকদার লিটনের পেছনে কারা কাজ করছেন তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণা করে আসা লিটনকে পেছনে থেকে কারা ইন্ধন দিচ্ছে তা তদন্ত করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক ইউনিট।

অর্ধডজন মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও একটি মামলায় সাজা হওয়া এই প্রতারককে ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা তেমন চোখে পড়েনি। তবে পুলিশ বলছে, লিটনকে ধরতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। বিভিন্ন সময় থানায় লিটনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কাগজ পৌঁছালেও সবসময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে গেছেন এই প্রতারক। এর ফলে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন তিনি।

স্থানীয়রা জানায়, এমন কোনো অপরাধ নেই, যার সঙ্গে জড়িত নেই সিকদার লিটন। বিশেষ করে চাঁদাবাজি, প্রতারণা ও প্রাণনাশের হুমকি, সাইবার অপরাধসহ প্রায় ডজনখানেক মামলার আসামি তিনি।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ফরিদপুর, খুলনা ও পাবনা জেলায় সিকদার লিটনের বিরুদ্ধে এসব মামলা রয়েছে। এর মধ্যে খুলনার সোনাডাঙ্গা মডেল থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ২০১৮ সালের ১৯ মার্চ। মামলা নং-২৪। চাঁদা দাবি এবং প্রাণনাশের হুমকির অপরাধে এই মামলা করা হয়।

এছাড়া পাবনা জেলার আটঘরিয়ায় একটি সি.আর মামলার আসামিও সে। মামলার নং-৪৯/১৪। এই মামলাটি করা হয়েছে প্রতারণার অভিযোগে। পাবনার আমিনপুর থানাতেও করা প্রাণনাশের একটি মামলার আসামি লিটন। ২০১৪ সালের ১৮ মে মামলাটি করা হয়। অপকর্মের অভিযোগে ২০১৬ সালের ৯ মে তার বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা থানায়। সিকদার লিটনের যত সাইবার অপরাধ সাইবার অপরাধেও অর্ধডজন মামলার আসামি সিকদার লিটন। তার বিরুদ্ধে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন থানায় দুই ডজনের বেশি সাধারণ ডায়েরিও রয়েছে।

ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সাইফারের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কুৎসা রটনার অভিযোগ আছে সিকদার লিটনের বিরুদ্ধে। ২০১৯ সালের ১৮ নভেম্বর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সিকদার লিটন ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে আলফাডাঙ্গা থানায় একটি অভিযোগ করেন সাইফার। যেটি সাধারণ ডায়েরি হিসেবে নিবন্ধিত হয়। যার নম্বর- ৮৭৫। ওইদিনই আলফাডাঙ্গার উপপরিদর্শক স্বপন কুমার ফরিদপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অভিযোগটি তদন্তের অনুমতি চান। তাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এর অধীনে ২৫/২৯ ধারায় অধর্তব্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। যেটি তদন্ত করা প্রয়োজন বলে মত দেয় পুলিশ। এর প্রেক্ষিতে গত বছরের ২৪ নভেম্বর আদালত তদন্তের অনুমতি দেয়। সেই সঙ্গে ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দিতে বলা হয়। পরে পুলিশি তদন্তে অপরাধের প্রমাণ পাওয়া যায় এবং প্রতিবেদনটি আদালতেও জমা দেওয়া হয়। কিন্তু এখনো ওই মামলায় শিকদার লিটনকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ফরিপুর-১ আসনের সাবেক সাংসদ আব্দুর রহমান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা এস এম আকরাম হোসেনকে নিয়ে ফেসবুকে নানা ধরনের অপপ্রচার ও সম্মানহানিকর তথ্য প্রচারের অভিযোগ আছে সিকদার লিটন ও তার ইন্ধনদাতাদের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ২০১৯ সালের ২ ডিসেম্বর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন আকরাম হোসেন। যার নং- ৯৬।

ফেসবুকে অসত্য ও মানহানিকর তথ্য প্রচারের অভিযোগে আলফাডাঙ্গা উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ও উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি এনায়েত হোসেনও সিকদার লিটনের বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন। এই দুটো অভিযোগ তদন্তের জন্য আদালতের অনুমতির অপেক্ষায় আছে পুলিশ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিকদার লিটনের বাড়ি আলফাডাঙ্গা উপজেলার টগরবন্দ ইউনিয়নের চর আজমপুর গ্রামে। ওই গ্রামের সিদ্দিক শিকদারের ছেলে সিকদার লিটন।

স্থানীয়দের কাছে তিনি প্রতারক ও ছদ্মবেশি অপরাধী বলেই বেশি পরিচিত। এলাকার মানুষকে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরে চাকরি দেওয়ার নাম করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সিকদার লিটন। একবার তার হাতে টাকা গেলে সেই টাকা কেউ ফেরত পেয়েছেন এমন নজির নেই। চাকরি দূরের কথা, টাকা চাইতে গেলে প্রাণনাশের হুমকি-ধমকি দেওয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। এসব অপরাধের অভিযোগে একাধিক মামলাও আছে তার বিরুদ্ধে। চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর লিটন ভুক্তভোগীর ফোন ধরা বন্ধ করে দেন। এসব কারণে আলফাডাঙ্গা ও টগরবন্দ থেকে তাকে তাড়িয়ে দেয়া হয়।

গ্রেপ্তার এড়াতে বিভিন্ন সময় আস্তানা গেড়েছেন। বেশি দিন এক নম্বর ব্যবহার করেন না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র বলছে, এলাকা থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর ঢাকা ছাড়াও খুলনার সীমান্ত এলাকা, পাবনাসহ বিভিন্ন জায়গা অবস্থায় নিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছেন লিটন। বর্তমানে ভাঙ্গা এবং গোপালগঞ্জে তার অবস্থান বলে জানা গেছে।

সম্প্রতি প্রতারণার বিভিন্ন খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলে সিকদার লিটন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ফেসবুকে গুজব ছড়াতে থাকে। মাঝে মাঝে ফেসবুক লাইভে এসে নেতাদের বিরুদ্ধে বাজে মন্তব্য করেন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক এমপি মো. আব্দুর রহমান, আলফাডাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এস এম আকরাম হোসেন, আলফাডাঙ্গা পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সাইফারের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কুৎসা রটাচ্ছেন। এসব অভিযোগে তার বিরুদ্ধে থানায় সাইবার অপরাধে মামলা হয়েছে, যা আদালতের নির্দেশে তদন্তাধীন। প্রতারণার অভিযোগে সিকদার লিটনের বিরুদ্ধে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা থানায় ৫/৭টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।

এছাড়া একাধিক সাইবার মামলার তদন্ত করছে থানা পুলিশ। পুলিশ বলছে, খুবই চালাক এই প্রতারক প্রতিনিয়ত নিজের অবস্থান পরিবর্তন করেন। যেখানেই অবস্থান করেন সেখানেই মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে সরে পড়েন। বহুরূপী এই প্রতারক বিভিন্ন সময় ডজনখানেক সিম নিজের নামে কিনেছেন। মধুখালী সার্কেল সহকারী পুলিশ সুপার আনিসুজ্জামান বলেন, ‘আমি একটু ব্যস্ত আছি। রাতে অভিযুক্তের বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারব। তবে সার্কেল অফিসে লিটনকে ডেকেছিলাম কিন্তু তিনি হাজির হয়নি। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম তার নামে ওয়ারেন্ট আছে থানায়। তবে সে এলাকায় নেই। এলাকায় থাকলে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হতো।’

মামলা ও ওয়ারেন্ট থাকলেও গ্রেপ্তারে দেরি কেন জানতে চাইলে ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মো. আলিমুজ্জামান বলেন, এটার বিষয় আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখবো। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।

এই বিভাগের আরও খবর