,

পাঁচ ঘাতক আজও অধরা

নিজস্ব প্রতিবেদক: বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত ছয় খুনির ফাঁসির রায় কার্যকর হলেও বিদেশে পালিয়ে থাকা পাঁচজনকে দেশে ফিরিয়ে আনা এখনো সম্ভব হয়নি। এই পাঁচ খুনির দুজনের অবস্থান শনাক্ত হয়েছে। অপর তিনজনের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশের নিজস্ব আইন পলাতকদের ফেরানোর ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে একদিকে এসব ঘাতক যেমন অধরাই রয়ে যাচ্ছে, তেমনই এদের পাওয়ার অপেক্ষায়ই থাকতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। তবে সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, গোপনীয়তার কারণে এ মুহূর্তে পলাতকদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সর্বশেষ তথ্য জানানো সম্ভব হচ্ছে না।

এর আগে আইনমন্ত্রী বলেছেন, ‘পলাতকদের ফিরিয়ে আনতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চলছে। এ বিষয়ে আপডেট থাকলেও আমি এই মুহূর্তে বলতে পারছি না কখন ফিরিয়ে আনা হবে। কারণ, আমাকে গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘পাবলিসিটি (প্রচার) পাওয়ার জন্য পাবলিসিটি দরকার, এ রকম আমি না। আমি ফলাফলে বিশ্বাসী। আমার কথা হচ্ছে, পলাতকদের ফিরিয়ে আনা হবে-এটুকু আমি বলতে পারি।’ সাজাপ্রাপ্তদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, ‘যারা সাজাপ্রাপ্ত, পলাতক এবং ফাঁসির আসামি, আইনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। রায়ের আলোকেই তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার প্রক্রিয়া চলছে।’

পলাতক পাঁচ খুনির মধ্যে রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং নূর চৌধুরীর কানাডা রয়েছে বলে জানা গেছে। তাদের ফেরানোর চেষ্টা চললেও কোনো অগ্রগতি নেই। মোসলেম উদ্দিন সম্প্রতি ভারতে ধরা পড়েছেন বলে সেদেশের গণমাধ্যমে খবর বের হলেও তার সত্যতা নিশ্চিত হতে পারেনি বাংলাদেশ সরকার। রশীদ ও ডালিম কোথায় আছে, তার খোঁজ এখনো পাননি দেশের গোয়েন্দারা। ইন্টারপোলের বাংলাদেশ শাখা ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) বরাবরের মতোই বলছে, পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে তারা। ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি খুনিদের আশ্রয়স্থল সম্ভব্য দেশগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ করা হচ্ছে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে সপরিবারে বাংলাদেশের স্বাধীনতার অবিসংবাদিত নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। এরপর খুনিদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেয় পরবর্তী সরকার। শুধু তা-ই নয়, খুনিদের বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে চাকরি দেওয়া হয়। সামরিক সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে খুনিরা রাজনৈতিক দল গঠন করে অনেক অপকর্ম করে। কোনো কানো খুনি এমপিও হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধে করা ইমডেমনিটি আইন বাতিল করা হয়। এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় খুনিদের বিচার প্রক্রিয়া। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে ২০১০ সালে ১২ খুনির মধ্যে পাঁচ খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তারা হলো : কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, কর্নেল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, লে. কর্নেল (অব.) মহিউদ্দিন আহমদ, মেজর (অব.) একে বজলুল হুদা এবং মেজর (অব.) একেএম মহিউদ্দিন (আর্টিলারি)। আর গত বছরের ১১ এপ্রিল রাতে বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। বাকি ছয়জনের মধ্যে আজিজ পাশা ২০০১ সালে জিম্বাবুয়েতে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করে।

এখনো অধরা ৫ খুনি : বিভিন্ন দেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছে লে. কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আবদুর রশিদ, মেজর (বরখাস্ত) শরিফুল হক ডালিম, লে. কর্নেল (অব.) এএম রাশেদ চৌধুরী, মেজর (অব.) এসএইচএমবি নূর চৌধুরী ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন খান। গ্রেফতার বা প্রত্যর্পণ ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, পাকিস্তান, লিবিয়াসহ আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বারবার অবস্থান বদল করেছে খুনিরা।

মৃত্যুদণ্ডই বাধা : কানাডায় অবস্থানকারী নূর চৌধুরী দেশটিতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছিল। কিন্তু তা খারিজ করে দিয়েছেন দেশটির আদালত। এ ব্যাপারে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে কথা বলেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া কোনো আসামিকে হস্তান্তর করা কানাডার আইন অনুযায়ী বৈধ নয়। এ কারণে আইনি জটিলতায় আটকে আছে নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনা। ২০০৪ সালে খুনি নূর চৌধুরীকে কানাডা থেকে বহিষ্কারের আদেশ দিয়েছিলেন দেশটির আদালত। তবে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে নূর চৌধুরীর অন্য এক আবেদনে ওই আদেশ ঝুলে থাকায় নূর চৌধুরী কানাডায় বসবাসের সুযোগ পাচ্ছে।

পলাতক খুনিদের আরেকজন মোসলেম উদ্দিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে বলে তথ্য রয়েছে। এর আগে তার ভারত ও জার্মানিতে অবস্থানের তথ্যও ছিল গোয়েন্দাদের কাছে। যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ থাকায় রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফেরত আনতে ২০১৫ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের আইনি পরামর্শক সংস্থা স্কাডেন এলএলপিকে যুক্ত করে বাংলাদেশ সরকার। সংস্থাটি এ বিষয়ে মর্কিন সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাশেদ চৌধুরীকে ফেরতের বিষয়ে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী ২০১৬ সালে মার্কিন আইন দপ্তরে চিঠি পাঠান। স্কাডেন এলএলপি ২০১৭ সালে জানায়, রাশেদ চৌধুরীকে যুক্তরাষ্ট্র ফেরত দিতে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। তারপর যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতায় আসেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

এদিকে খুনি রাশেদ চৌধুরীর মামলার রিভিউ করার জন্য নথি পাঠাতে অভিবাসন বোর্ডকে নির্দেশ দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার। এমন নির্দেশের পর রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা দেখা দেয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রে এ আইনি প্রক্রিয়া কবে নাগাদ শেষ হবে সে বিষয়ে কেউ স্পষ্ট কিছু বলতে পারছেন না। রাশেদ চৌধুরীর রাজনৈতিক আশ্রয় পর্যালোচনার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেলের নথি তলবের মাধ্যমে এ প্রক্রিয়ায় অগ্রগতি হচ্ছে বলে নির্ভরযোগ্য কূটনৈতিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘আমরা তো পাঁচ জনের মধ্যে তিনজনের কোনো খবর জানি না। যদি কেউ খবর দিতে পারেন, তাদের আমরা পুরস্কৃত করব। এই তিনজন সম্পর্কে কেউ কেউ বলেন, পাকিস্তান, জার্মানি ও স্পেনে আছেন। শুনলে পরে আমরা দূতাবাসকে বলি, তারা বলেন এটা ভুয়া খবর। দুজনের খবর আমরা জানি, একজন আমেরিকায়, আরেকজন কানাডায়।’

তিনি বলেন, ‘নূর চৌধুরী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হওয়ায় কানাডা সরকার বলছে, যেহেতু তার ফাঁসি হয়ে যাবে, সেজন্য তারা তাকে দেবে না। আমেরিকায় রাশেদ চৌধুরী ভুল তথ্য দিয়ে নাগরিক হয়েছেন। ছেলে-মেয়ের সঙ্গে থাকেন। আমেরিকার নিয়ম হচ্ছে ভুল তথ্য দিলে অথবা যুদ্ধাপরাধী হলে সে দেশে তারা রাখে না। কিন্তু সে ভুল তথ্য দিয়ে নাগরিক হয়ে গেছে। এ বিষয়ে আমরা একটি আপিল করেছি। এখন তারা সেটি পরীক্ষা করার জন্য অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে পাঠিয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে আজ দুই বছর ধরে ফাইল পড়ে আছে। আমরা তো স্টেট ডিপার্টমেন্টকে বলেছি, এখন এটা তাদের এখতিয়ার। তবুও আমি আশা করি, আমেরিকায় যিনি আছেন দেরিতে হলেও তাকে আমরা দেশে আনতে পারব। তারা ইসরাইলের অনেক যুদ্ধাপরাধীকে দেশে পাঠিয়েছে। মন্ত্রী বলেন, ‘আমেরিকায় নতুন সরকার এসেছে, নতুন অ্যাটর্নি জেনারেল এসেছেন, প্রসেসিং সমস্যা হচ্ছে।’

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের অনুরোধে রাজনৈতিক আশ্রয় না পাওয়া বঙ্গবন্ধুর খুনি একেএম মহিউদ্দিনকে ফেরত দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।

নিশ্চিত নয় অবস্থান : দুই খুনি শরিফুল হক ডালিম ও আবদুর রশিদের অবস্থানের ব্যাপারে সরকারের কাছে কোনো নিশ্চিত তথ্য নেই। তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, লিবিয়া, সেনেগালসহ বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করলেও তারা স্থায়ীভাবে পাকিস্তানে বসবাস করছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে পাকিস্তানের কাছে জানতে চাওয়া হলেও কোনো উত্তর দেয়নি তারা।

যে ৫ খুনি বিভিন্ন দেশে আত্মগোপনে রয়েছে, তাদের গ্রেফতারের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনতে জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ সদর দপ্তরের ইন্টারপোল শাখা। এদের গ্রেফতারে পুলিশ সদর দপ্তরের ইন্টারপোল শাখা থেকে সম্প্রতি ১৯৩টি দেশের ইন্টারপোল শাখার সঙ্গে যোগাযোগ করে জারি করা রেড নোটিশ রিভিউ করা হয়েছে। তবে বন্দিবিনিময় চুক্তি না থাকায় আত্মস্বীকৃত খুনিদের ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না।

এই বিভাগের আরও খবর